✍️ ড. লোকমান খান

ভূমিকা: শৈশব থেকে কৈশোরে শেখার রূপান্তর

শিক্ষা কেবল পাঠ্যবই মুখস্থ করার প্রক্রিয়া নয়; এটি একটি গভীর মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক এবং আবেগগত অভিযাত্রা। মাধ্যমিক স্তর (Secondary Age, সাধারণত ১১ থেকে ১৬ বছর) হলো শিক্ষার্থীর জীবনে এক বিরাট মনস্তাত্ত্বিক ও শিক্ষাগত সন্ধিক্ষণ। এই সময়টিতে তারা শৈশব থেকে কৈশোরে প্রবেশ করে, শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়, আত্মপরিচয়ের সন্ধান পায় এবং স্বাধীন চিন্তাভাবনা গড়ে তোলে। এই সময়ে তাদের শেখার প্রক্রিয়া শৈশবের খেলার-ভিত্তিক পদ্ধতি থেকে সরে এসে আরও জটিল, বিমূর্ত এবং সমালোচনামূলক চিন্তার দিকে ধাবিত হয়। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ হিসেবে আমি মনে করি, এই বয়সে শেখার প্রক্রিয়াকে বোঝা অত্যন্ত জরুরি, কারণ এই স্তরের শিক্ষা শুধু ডিগ্রি অর্জনের জন্য নয়, বরং একজন দায়িত্বশীল নাগরিক এবং স্বাধীন চিন্তাবিদ হিসেবে গড়ে ওঠার ভিত্তি। এই প্রবন্ধে আমি মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শেখার মূল প্রক্রিয়া, মস্তিষ্ক বিকাশের প্রভাব এবং কার্যকর শিক্ষণ কৌশলগুলি নিয়ে আলোচনা করব।

এই প্রবন্ধে আমি আলোচনা করব—

১. জ্ঞানীয় ও স্নায়বিক বিকাশ: বিমূর্ত চিন্তার উদয়

২. সামাজিক ও আবেগিক প্রভাব: পিয়ার গ্রুপ এবং পরিচিতি গঠন

৩. কার্যকর শিক্ষণ কৌশল: সক্রিয়তা, প্রাসঙ্গিকতা এবং মেটা-কগনিশন

৪. শিক্ষক, পরিবার ও সমাজের ভূমিকা

১. জ্ঞানীয় ও স্নায়বিক বিকাশ: বিমূর্ত চিন্তার উদয়

কৈশোরকালে শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে যে পরিবর্তনগুলি আসে, তা তাদের শেখার ধরনকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এই বয়সে শেখার ভিত্তি প্রধানত দুটি পরিবর্তনের উপর নির্ভরশীল: বিমূর্ত চিন্তার বিকাশ এবং কার্যকরী স্মৃতিশক্তির সম্প্রসারণ।

ক. বিমূর্ত চিন্তার সক্ষমতা (Abstract Thinking)

মনোবিজ্ঞানী জ্যাঁ পিয়াজে (Jean Piaget)-এর মতে, এই বয়সে শিক্ষার্থীরা ফর্মাল অপারেশনাল স্টেজে প্রবেশ করে। এর অর্থ হলো:

  • তারা মূর্ত (Concrete) বস্তুর উপর নির্ভর না করে বিমূর্ত ধারণা (Abstract Concepts) যেমন—গণিতের জটিল সূত্র, পদার্থবিজ্ঞানের নীতি, ইতিহাস ও দর্শনের গভীর ধারণাগুলি বুঝতে পারে।
  • তারা তর্কবিদ্যা (Logic) প্রয়োগ করে। যেমন, “যদি X ঘটে, তাহলে Y ঘটবে”—এই ধরনের অনুমানভিত্তিক যুক্তি (Hypothetical-Deductive Reasoning) ব্যবহার করে তারা সমস্যার সমাধান করতে পারে।
  • এই সক্ষমতার কারণে তারা সাহিত্য, দর্শন, উচ্চতর বিজ্ঞান ও গণিত শেখার জন্য প্রস্তুত হয়। শিক্ষক হিসেবে আমাদের উচিত কেবল তথ্য না দিয়ে, ধারণাগুলির গভীরতা নিয়ে আলোচনা করা।

খ. কার্যনির্বাহী কার্যাবলী (Executive Functions) এবং স্মৃতি

কৈশোরে মস্তিষ্কের প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্স (Pre-frontal Cortex)-এর বিকাশ দ্রুত হয়। এটি কার্যনির্বাহী কার্যাবলী (যেমন পরিকল্পনা, অগ্রাধিকার নির্ধারণ, আবেগ নিয়ন্ত্রণ) এবং কার্যকরী স্মৃতি (Working Memory)-এর জন্য দায়ী।

  • কার্যকরী স্মৃতি: তথ্য ধরে রাখা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগানোর ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা একসঙ্গে একাধিক কাজ (Multitasking) এবং দীর্ঘ প্রকল্প (Long Projects) পরিচালনা করতে পারে।
  • শিক্ষণ কৌশল: এই সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে হলে শিক্ষকদের উচিত স্ব-নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা (Self-Regulated Learning) এবং সময় ব্যবস্থাপনার উপর জোর দেওয়া।

ফলে দেখা যায়—

• তারা স্বাধীনতা চায়, কিন্তু এখনো পরিণত আত্মনিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি অর্জন করেনি।

• তারা মতামত প্রকাশে আগ্রহী, কিন্তু সমালোচনা গ্রহণে সংবেদনশীল।

• তারা অন্যদের মতামত ও গ্রহণযোগ্যতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।

এই মানসিক অবস্থাই নির্ধারণ করে তাদের শেখার ধরণ। উদাহরণস্বরূপ, এই বয়সে বক্তৃতা বা নির্দেশের চেয়ে অংশগ্রহণমূলক শেখা (participatory learning) বেশি কার্যকর। তারা চায়, তাদের কথা শোনা হোক; তাই “শিক্ষক বললেন, শিক্ষার্থী লিখল”—এই প্রচলিত কাঠামো আর যথেষ্ট নয়।

২. কীভাবে তারা চিন্তা করে ও শেখে: সামাজিক ও আবেগিক প্রভাব

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়া কেবল জ্ঞানীয় নয়, এটি সামাজিক ও আবেগিক প্রেক্ষাপট দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত।

ক. পিয়ার গ্রুপের প্রভাব (Peer Group Influence)

এই বয়সে, পরিবার বা শিক্ষকের চেয়ে সহপাঠী বা পিয়ার গ্রুপ-এর মতামত এবং সমর্থন শিক্ষার্থীর কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

  • দলগত শিক্ষা (Collaborative Learning): শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে কাজ করা বা আলোচনা করার মাধ্যমে সহজে ও কার্যকরভাবে শেখে। এটি তাদের যোগাযোগ দক্ষতা এবং দলগত সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
  • পরিচিতি গঠন (Identity Formation): তারা নিজেদেরকে একটি দলের অংশ হিসেবে দেখতে পছন্দ করে। শিক্ষাবিদ হিসেবে আমাদের উচিত ইতিবাচক সামাজিক মিথস্ক্রিয়া-এর সুযোগ তৈরি করা এবং ক্লাসরুমে যেন সম্মান ও অন্তর্ভুক্তির পরিবেশ বজায় থাকে, তা নিশ্চিত করা।

খ. আবেগ ও ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা

কৈশোরকালে মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম (Limbic System), যা আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য দায়ী, প্রি-ফ্রন্টাল কর্টেক্সের তুলনায় দ্রুত পরিপক্ক হয়। এর ফলে:

  • শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র আবেগপ্রবণতা এবং ঝুঁকি গ্রহণের উচ্চ প্রবণতা দেখা যায়।
  • শেখার প্রক্রিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হবে। যে বিষয়টি তাদের জীবনে প্রাসঙ্গিক, তারা তা শিখতে আগ্রহী হয়।শিক্ষকদের উচিত আবেগিক বুদ্ধি (Emotional Intelligence) এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করা, যাতে শেখার ক্ষেত্রে কোনো আবেগিক বাধা না আসে।

গ. কৌতূহল ও যুক্তিবোধ

এই বয়সে তাদের মধ্যে প্রবল কৌতূহল দেখা যায়—

• কেন নিয়ম আছে?

• কেন আমি এটা শিখছি?

• এর বাস্তব জীবনে প্রয়োগ কী?

যদি এই প্রশ্নগুলোর সন্তোষজনক উত্তর না পায়, তারা শেখার প্রতি আগ্রহ হারায়। তাই একজন দক্ষ শিক্ষক কেবল “কি” শেখাবেন তা নয়, “কেন” শেখানো হচ্ছে—এ বিষয়েও আলোকপাত করেন।

ঘ. সামাজিক শেখা (Social Learning)

১১–১৬ বছর বয়সে সমবয়সীদের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। “বন্ধুরা কী ভাববে” তা অনেক সময় শিক্ষক বা অভিভাবকের কথার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এই কারণে দলগত কাজ, সহযোগিতামূলক শেখা (collaborative learning), এবং সহপাঠী মূল্যায়ন (peer assessment) এই বয়সে অসাধারণ ফল দেয়।

৩. কার্যকর শিক্ষণ কৌশল: সক্রিয়তা, প্রাসঙ্গিকতা এবং মেটা-কগনিশন

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শেখার সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে শিক্ষণ কৌশলগুলিতে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। একজন শিক্ষাবিদ জানেন, সব শিক্ষার্থী একভাবে শেখে না। তবে ১১–১৬ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের শেখার কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলির ওপর ভিত্তি করে কার্যকর পদ্ধতি গড়ে তোলা যায়।

ক. সক্রিয় শিক্ষা (Active Learning) বনাম নিষ্ক্রিয় গ্রহণ

এই বয়সের শিক্ষার্থীরা শুধু শিক্ষকের বক্তৃতা শুনে বা বই পড়ে নিষ্ক্রিয়ভাবে জ্ঞান গ্রহণ করতে চায় না। তাদের শেখা তখনই গভীর হয় যখন তারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে।

  • সমস্যা-ভিত্তিক শিক্ষা (Problem-Based Learning – PBL): বাস্তব জীবনের সমস্যা তাদের সামনে উপস্থাপন করা, যা সমাধানের জন্য তাদের গবেষণা, বিশ্লেষণ এবং দলগত কাজ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি নির্দিষ্ট এলাকার ট্রাফিক জ্যাম কমানোর কৌশল তৈরি করা।
  • বিতর্ক ও আলোচনা: যেকোনো বিষয়ের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক এবং খোলামেলা আলোচনা শিক্ষার্থীদের সমালোচনামূলক চিন্তাকে ধারালো করে।
  • অভিজ্ঞতাভিত্তিক শেখা (Experiential Learning)তারা সরাসরি অভিজ্ঞতা থেকে শেখায় সবচেয়ে বেশি আগ্রহী। উদাহরণস্বরূপ—• বিজ্ঞানে পরীক্ষাগারভিত্তিক কাজ• ইতিহাসে ঐতিহাসিক ঘটনার নাট্যরূপ• ভাষায় বিতর্ক, রচনা বা সৃজনশীল উপস্থাপনা

খ. প্রাসঙ্গিকতা (Relevance) প্রতিষ্ঠা

“আমি কেন এটা শিখব?” – এই প্রশ্নটি কৈশোরের শিক্ষার্থীরা প্রায়শই করে। যদি তারা শেখার বিষয়টির বাস্তব জীবনের বা ভবিষ্যতের প্রাসঙ্গিকতা দেখতে পায়, তবে তাদের আগ্রহ বাড়ে।

  • কেরিয়ার সংযোগ: বিজ্ঞান বা গণিতের ধারণাগুলি কীভাবে বিভিন্ন পেশায় ব্যবহৃত হয়, তা দেখানো।
  • আন্তঃবিষয়ক সংযোগ (Interdisciplinary Connection): ইতিহাস, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের ধারণাগুলি একে অপরের সাথে কীভাবে যুক্ত, তা ব্যাখ্যা করা।

গ. মেটা-কগনিশন (Metacognition) এবং স্ব-প্রতিফলন

মেটা-কগনিশন হলো “চিন্তা সম্পর্কে চিন্তা করা” বা নিজের শেখার প্রক্রিয়াকে বোঝা এবং নিয়ন্ত্রণ করা। এই বয়সে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সক্ষমতা তৈরির উপর জোর দেওয়া উচিত।

  • শিক্ষণ কৌশল শেখানো: কীভাবে নোট নিতে হয়, পরীক্ষার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়, এবং কোন কৌশলটি তাদের জন্য সবচেয়ে কার্যকর — এই বিষয়গুলি তাদের শিখিয়ে দেওয়া।
  • স্ব-প্রতিফলন (Self-Reflection): অ্যাসাইনমেন্ট বা পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করা উচিত: “তোমার এই ফলাফল কেন হলো? তুমি কি অন্যভাবে পড়তে পারতে?” – এর ফলে তারা নিজেরাই নিজেদের ভুল সংশোধন করতে পারে।

ঘ. চ্যালেঞ্জ ও লক্ষ্যনির্ভর শেখা

এই বয়সে তারা প্রতিযোগিতা ও সাফল্য দুটোই পছন্দ করে। ছোট ছোট লক্ষ্য নির্ধারণ করে সেটি অর্জনের সুযোগ দিলে তারা আগ্রহী হয়। যেমন—

“আজকের ক্লাসে আমরা তিনটি রাসায়নিক বিক্রিয়া চিহ্নিত করব”

“তুমি পারলে এই সমস্যাটা তিনভাবে সমাধান করে দেখাও”

এমন কাজ শেখার মধ্যে উত্তেজনা ও আত্মবিশ্বাস দুটোই জাগায়।

ঙ. প্রযুক্তি ও ডিজিটাল শেখা

বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল পরিবেশে বড় হচ্ছে। স্মার্টফোন, ট্যাব, অনলাইন ভিডিও, ইন্টার‌্যাকটিভ অ্যাপ—এসব তাদের শেখার প্রক্রিয়ার অংশ। সঠিকভাবে ব্যবহার করলে প্রযুক্তি শিক্ষার এক শক্তিশালী সহায়ক মাধ্যম হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ:

• সিমুলেশন বা ভার্চুয়াল ল্যাব

• অনলাইন কুইজ ও গেমিফিকেশন

• ভিডিও টিউটোরিয়াল ও অ্যানিমেশন

তবে প্রযুক্তিকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা উচিত, বিকল্প হিসেবে নয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মানবিক সংযোগই শেখার প্রাণশক্তি।

চ. মূল্যায়নের ধরন

এই বয়সের শিক্ষার্থীরা নিয়মিত “ফিডব্যাক” পেলে ভালো শেখে। কেবল নম্বর নয়, তারা জানতে চায়—

“আমি কীভাবে আরও ভালো করতে পারি?”

গঠনমূলক মূল্যায়ন (formative assessment) যেমন ছোট কুইজ, শ্রেণিকক্ষে আলোচনা, আত্মমূল্যায়ন ইত্যাদি—তাদের শেখাকে ধারাবাহিকভাবে উন্নত করে।

৪. শিক্ষক, পরিবার ও সমাজের ভূমিকা

শিক্ষার্থীর শেখা কখনো একা ঘটে না। এটি একটি তিনস্তরীয় কাঠামো—শিক্ষক, পরিবার ও সমাজ মিলেই একটি শিক্ষণ পরিবেশ তৈরি করে।

ক. শিক্ষকের ভূমিকা

একজন দক্ষ শিক্ষক কেবল তথ্যদাতা নন; তিনি একজন পরিচালক, পরামর্শদাতা ও অনুপ্রেরণাদাতা।

তিনি—

• প্রতিটি শিক্ষার্থীর শেখার ধরন বুঝে তা অনুযায়ী পাঠদান করেন

• ভুলকে অপরাধ নয়, শেখার সুযোগ হিসেবে দেখান

• ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলেন

এই বয়সে শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীর ওপর বিশ্বাস রাখেন, সেই শিক্ষার্থী নিজের মধ্যেও বিশ্বাস তৈরি করে।

খ. পরিবারের ভূমিকা

পরিবার হলো শিক্ষার্থীর প্রথম ও স্থায়ী বিদ্যালয়।

১১–১৬ বছর বয়সে সন্তানরা অনেক সময় “অভিভাবকের নির্দেশের বিরুদ্ধে” যায়, কিন্তু অন্তরে তারা এখনো দিকনির্দেশনা খোঁজে। তাই অভিভাবকের দায়িত্ব—

• সন্তানের কথা শোনা, কেবল শাসন করা নয়

• তার আগ্রহ ও মানসিক অবস্থা বোঝা

• শেখার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করা

শিক্ষা কখনোই কেবল বিদ্যালয়ের বিষয় নয়; ঘরেও শেখা অব্যাহত থাকে।

গ. সমাজের ভূমিকা

একটি সহায়ক সমাজ শেখার সুযোগ তৈরি করে। ক্রীড়া, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, স্বেচ্ছাসেবা, বিজ্ঞান মেলা—এসব শিক্ষার্থীর বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে। সমাজ যদি কেবল পরীক্ষার ফলাফল নয়, বরং নৈতিকতা, সৃজনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেয়, তাহলে শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য পূরণ হয়।

৫. বিশেষ মনোযোগের ক্ষেত্র

ক. লিঙ্গ ও সামাজিক বৈষম্য

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক অঞ্চলে এখনো মেয়েরা শিক্ষায় পিছিয়ে থাকে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক বাধার কারণে। শিক্ষক ও প্রশাসকদের উচিত শ্রেণিকক্ষকে এমনভাবে গঠন করা যাতে লিঙ্গ, ধর্ম বা অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে কোনো শিক্ষার্থী নিজেকে “কম” মনে না করে।

খ. মানসিক স্বাস্থ্য ও চাপ

এই বয়সে পরীক্ষার চাপ, সামাজিক প্রতিযোগিতা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। বিদ্যালয়ে counselling service ও সহানুভূতিশীল শিক্ষক-সংস্কৃতি অপরিহার্য।

গ. বহুমাত্রিক প্রতিভা

প্রত্যেক শিক্ষার্থী গণিত বা বিজ্ঞানে সমান দক্ষ নয়—কারও হয়তো শিল্প, ক্রীড়া, সংগীত, কিংবা প্রযুক্তিগত দক্ষতা রয়েছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত এই প্রতিভাগুলিকে চিহ্নিত করা ও লালন করা।

উপসংহার: ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা

১১–১৬ বছর বয়সের শিক্ষার্থীরা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে থাকে। তারা আর শিশু নয়, আবার পুরোপুরি প্রাপ্তবয়স্কও নয়। তাদের শেখা কেবল পাঠ্যসূচি শেষ করা নয়—এটি চিন্তা, মূল্যবোধ, আত্মপরিচয় ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া।

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের শেখার প্রক্রিয়াটি শৈশবের চেয়ে অনেক বেশি স্ব-নির্ভরশীল, বিশ্লেষণাত্মক এবং সামাজিক। তাদের মস্তিষ্ক জটিল তথ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য প্রস্তুত, কিন্তু একই সময়ে তারা আবেগিক ও পরিচিতি গঠনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়।

শিক্ষক যদি তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন, পাঠ যদি বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, পরিবার যদি সমর্থন দেয় এবং সমাজ যদি মূল্যবোধনির্ভর হয়—তবে এই বয়সের শিশুরা কেবল ভালো ফলাফলই করবে না, বরং হবে চিন্তাশীল, আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্বশীল নাগরিক।

একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো—কেবল পাঠ্যসূচি শেষ করা নয়, বরং এমন একটি শিক্ষণ পরিবেশ তৈরি করা যেখানে বিমূর্ত ধারণাগুলি মূর্ত হয়ে ওঠে, দলগত কাজকে উৎসাহিত করা হয়, এবং শিক্ষার্থীরা নিজেদের শেখার প্রক্রিয়ার কর্তা (owner) হয়ে ওঠে। সঠিক দিকনির্দেশনা এবং সহায়ক পরিবেশ পেলে, এই শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষায় সফল হয় না, বরং সমালোচনামূলক চিন্তা করতে সক্ষম, আত্মবিশ্বাসী এবং দায়িত্বশীল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষে পরিণত হয়, যা ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য।

একজন অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদের চোখে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো—

শিশুকে এমনভাবে শেখানো, যাতে সে কেবল জীবিকা অর্জন নয়, জীবনকে বোঝা ও মানবিকভাবে বাঁচতে শেখে।

১৫ অক্টোবর ২০২৫


Discover more from LK INNOVATE

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment

Trending

Discover more from LK INNOVATE

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading