✍️ ড. লোকমান খান
১. বিশ্ববিদ্যালয় মানে কী?
প্রায় প্রতিটি দেশের একটি বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থাকে যা সেই দেশের মেধার প্রতীক, চিন্তার কারখানা, এবং জাতির ভবিষ্যতের স্থপতি।
যুক্তরাজ্যের কথা ধরুন—অক্সফোর্ড আর ক্যামব্রিজ শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, এগুলো দেশের নীতিনির্ধারণের প্রাণকেন্দ্র। দেশ পরিচালনার জন্য যে নেতারা, নীতিনির্ধারকরা, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, দার্শনিক, এমনকি রাজনীতিবিদরা প্রস্তুত হন—তাদের বড় একটি অংশ আসে এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রে হার্ভার্ড, এমআইটি, স্ট্যানফোর্ড একইভাবে দেশের অর্থনীতি, প্রযুক্তি, এবং নীতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।
চীনের তসিংহুয়া ইউনিভার্সিটি আর ভারতের আইআইটিগুলোও তাদের দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে দিচ্ছে।
বাংলাদেশে সেই প্রতীকী বিশ্ববিদ্যালয় হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)।
এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু একটি প্রশ্ন আজকে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি তার সেই আইকনিক মর্যাদা ধরে রাখতে পেরেছে? নাকি আমরা ধীরে ধীরে গৌরব হারিয়ে ফেলছি?
২. অতীতের গৌরব: জাতির জন্মের সাক্ষী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিহাস নয়—এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথেই মিশে আছে।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য উচ্চশিক্ষার এক আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে।
বাংলার নবজাগরণের শেষভাগ, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ—সবগুলোতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অসাধারণ।
- ভাষা আন্দোলন: ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব এসেছে ঢাবি থেকে। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার—এই নামগুলো শুধু শহীদ নন, তাঁরা ঢাবির ছাত্র ছিলেন।
- মুক্তিযুদ্ধ: ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম আঘাতের শিকার। ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাবি ক্যাম্পাস রক্তে রঙিন হয়েছিল।
এটি দেখায় যে ঢাবি শুধুমাত্র একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি জাতির চেতনার প্রতীক।
কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এসে আমরা কি সেই চেতনাকে ধরে রাখতে পেরেছি?
৩. বর্তমান বাস্তবতা: পতনের লক্ষণ
আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে অনেকেই হতাশ হন। কারণ, অতীতের সেই বৌদ্ধিক নেতৃত্ব আজ যেন ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু।
শিক্ষা ও গবেষণার মান:
- বিশ্ব র্যাংকিংয়ে ঢাবির অবস্থান সন্তোষজনক নয়।
- মৌলিক গবেষণা, আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনা, এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে ঢাবির অবদান তুলনামূলকভাবে কম।
- শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে আধুনিকতার ঘাটতি রয়েছে। অনেক শিক্ষার্থী কেবল পরীক্ষায় পাস করার জন্য মুখস্থ নির্ভর পড়াশোনায় অভ্যস্ত।
রাজনীতিকরণ:
ঢাবি আজ অনেকাংশে রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
- শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে ভর্তি প্রক্রিয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষণীয়।
- ছাত্র রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রে নীতিগত নেতৃত্ব তৈরি না করে ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে পর্যবসিত হয়েছে।
- সাধারণ শিক্ষার্থীরা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেন।
এই অবস্থা শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের নয়, পুরো দেশের জন্যই উদ্বেগের কারণ। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয় বাংলাদেশের মিনি পার্লামেন্ট। এখানেই আগামী দিনের নেতারা তৈরি হয়।
৪. ডাকসু: একটি গণতান্ত্রিক পরীক্ষাগার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ বা ডাকসু (DUCSU) হলো এই মিনি পার্লামেন্টের প্রতীক।
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে ডাকসু বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল।
ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ—সবগুলোতেই ডাকসুর ভূমিকা অনন্য।
এটি শুধু একটি ছাত্র সংগঠন নয়, বরং এটি একটি গণতান্ত্রিক শিক্ষার ক্ষেত্র।
- এখানে শিক্ষার্থীরা শিখে কিভাবে নেতৃত্ব দিতে হয়।
- কিভাবে বিতর্ক করতে হয়, সমঝোতা করতে হয়।
- কিভাবে নীতি নির্ধারণ করতে হয়।
দুঃখজনকভাবে, গত কয়েক দশক ধরে ডাকসু কার্যত নিষ্ক্রিয় ছিল। ১৯৯০ সালের পর দীর্ঘ প্রায় ২৮ বছর ডাকসু নির্বাচন হয়নি।
এর ফলে একটি প্রজন্ম গণতান্ত্রিক প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
২০১৯ সালে নির্বাচন হলেও তা নানা বিতর্কে জর্জরিত হয়েছিল।
ফলাফল ঘোষণার পর ব্যাপক অভিযোগ ওঠে কারচুপি ও অনিয়ম নিয়ে।
এটি আবারও প্রমাণ করে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কতটা নাজুক।
৫. কেন ডাকসু নির্বাচন এত গুরুত্বপূর্ণ?
অনেকেই প্রশ্ন করেন, “ডাকসু নির্বাচন নিয়ে এত হৈচৈ কেন? এটি তো কেবল একটি ছাত্র সংসদ।”
কিন্তু বিষয়টি এতটা সরল নয়।
প্রথমত, ডাকসু হলো ভবিষ্যতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরির পরীক্ষাগার।
আজ যারা ডাকসুর নেতা, আগামীকাল তারা সংসদে যাবে, মন্ত্রী হবে, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও হতে পারে।
এখানে যদি স্বচ্ছ নির্বাচন না হয়, যদি গণতান্ত্রিক চর্চা বিকৃত হয়, তবে জাতীয় রাজনীতিতেও সেই বিকৃতি প্রতিফলিত হবে।
দ্বিতীয়ত, ডাকসু হলো নীতিনির্ধারণে চাপ সৃষ্টি করার একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।
- শিক্ষা নীতি
- গবেষণা বাজেট
- শিক্ষার্থীদের অধিকার
এই সব কিছুর উপর ডাকসু প্রভাব ফেলতে পারে।
তৃতীয়ত, এটি একটি বার্তা।
যদি ঢাবিতে স্বচ্ছ, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়, তবে তা দেশের বাকী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্যও উদাহরণ হবে।
যদি এখানে কারচুপি হয়, তবে তা গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত।
৬. শিক্ষার মান উন্নয়নে ডাকসুর ভূমিকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সংকট শুধু রাজনৈতিক নয়, একাডেমিকও বটে।
শিক্ষার মান, গবেষণার পরিধি, এবং আন্তর্জাতিক সংযোগ—সব ক্ষেত্রেই উন্নতি প্রয়োজন।
ডাকসু এই পরিবর্তনে কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
কিছু বাস্তব প্রস্তাবনা নিচে দেওয়া হলো:
ক. শিক্ষা নীতিতে চাপ প্রয়োগ
ডাকসু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে নিম্নলিখিত বিষয়ে কাজ করতে পারে:
- আধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু করা।
- ডিজিটাল রিসোর্স এবং অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের প্রসার।
- আন্তর্জাতিক মানের কারিকুলাম তৈরি।
খ. গবেষণার বাজেট বৃদ্ধি
গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ডাকসু শিক্ষার্থীদের পক্ষে সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি জানাতে পারে যাতে গবেষণার জন্য নির্দিষ্ট বাজেট রাখা হয়।
গ. শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা
রাজনৈতিক সহিংসতা এবং হুমকিমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলা ডাকসুর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব।
শুধু রাজনীতি নয়, নারীদের নিরাপত্তা এবং সমান সুযোগ নিশ্চিত করাও জরুরি।
৭. বিদেশি উদাহরণ: শেখার সুযোগ
আমরা যদি বিদেশের দিকে তাকাই, অনেক কিছু শেখার আছে।
- অক্সফোর্ড-ক্যামব্রিজে ছাত্র সংসদগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- সেখানে ছাত্রনেতারা শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে প্রশাসনের সাথে সমাধান খোঁজে।
- তাদের কাজ শুধু রাজনৈতিক স্লোগান দেওয়া নয়, বরং নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার।
ঢাবিতেও একইভাবে ছাত্রনেতাদের উচিত শিক্ষার্থীদের জন্য বাস্তবসম্মত নীতি তৈরি করা।
৮. সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আবারো জাতির গর্বে পরিণত করতে হলে কিছু মৌলিক পদক্ষেপ নিতে হবে।
১. অবাধ ও সুষ্ঠু ডাকসু নির্বাচন
এটি প্রথম শর্ত।
যদি শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে না পারে, যদি ফলাফল পূর্বনির্ধারিত হয়, তবে এর কোনো অর্থই থাকবে না।
২. শিক্ষার মান উন্নয়ন
- শিক্ষক প্রশিক্ষণ
- আধুনিক ল্যাবরেটরি
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
৩. রাজনীতির স্বচ্ছতা
ছাত্র রাজনীতি থাকা দরকার, তবে সেটিকে নীতি-ভিত্তিক হতে হবে।
কেবল ক্ষমতা দখলের জন্য নয়, বরং শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করতে হবে।
৪. সমাজের অংশগ্রহণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল ঢাকার নয়, পুরো বাংলাদেশের।
- প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের (Alumni) অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
- শিল্পপতি, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে হবে।
৯. উপসংহার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জাতির হৃদয়ের স্পন্দন।
এখানে যে পরিবর্তন হবে, তা দেশের প্রতিটি স্তরে প্রতিফলিত হবে।
ডাকসু নির্বাচন কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচন নয়—এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের সূচক।
আজকের ডাকসু যদি স্বচ্ছ হয়, যদি গণতান্ত্রিক হয়, তবে আগামী দিনের জাতীয় নেতৃত্বও সেই মান বজায় রাখবে।
কিন্তু যদি এটি দুর্নীতি, সহিংসতা, আর কারচুপির প্রতীক হয়ে থাকে, তবে পুরো জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢাকা পড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ইতিহাস আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।
এখন আমাদের দায়িত্ব সেই ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে আগামী প্রজন্ম আবার গর্ব করে বলতে পারে:
“হ্যাঁ, এটাই সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতি নেতৃত্ব পেয়েছে, নীতি পেয়েছে, এবং আলোর পথ পেয়েছে।”






Leave a comment