✍️ ড. লোকমান খান

বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নিয়ে চলছে এক বিপ্লব। পশ্চিমা দেশ ও চীনে এআই-এর উন্নয়ন এতটাই দ্রুত যে অনুমান করা হয়, মাত্র এক দশকের মধ্যেই অনেক কাজ মানুষের বদলে এআই দিয়ে সম্পন্ন হবে, আর প্রায় সব চাকরির জন্যই অন্তত কিছুটা এআই জ্ঞান থাকা প্রয়োজন হবে। ইতিমধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে ২০৩০ সাল নাগাদ এআই প্রযুক্তি ৯২ মিলিয়ন চাকরি বিলুপ্ত করবে, তবে একই সঙ্গে সৃষ্টি করবে ১৭০ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান। অর্থাৎ চাকরি পুরোপুরি হারিয়ে যাবে না, কিন্তু যে ধরণের কাজ থাকবে তার প্রকৃতি বদলে যাবে। ফোরামের আরেকটি জরিপে ৪০% নিয়োগদাতা জানিয়েছেন, এআই দিয়ে যেসব কাজ স্বয়ংক্রিয় করা যায়, সেসব ক্ষেত্রে তারা কর্মীসংখ্যা কমাবেন। উদাহরণস্বরূপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বাজার গবেষণা বিশ্লেষক ও বিক্রয় প্রতিনিধিদের অর্ধেকের বেশি কাজ স্বয়ংক্রিয় করতে পারবে বলে ধারণা। শুধু তা-ই নয়, ৭৬% পেশাজীবী মনে করছেন চাকরির বাজারে টিকে থাকতে এআই দক্ষতা অর্জন আবশ্যক। বিশ্বের এই অভিজ্ঞতা আমাদের স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে: এআইয়ের জোয়ারে পাল তুলতে হবে, নইলে পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বৈশ্বিক এআই বিপ্লব ও চাকরির ভবিষ্যৎ

এআই কোনো কাল্পনিক গল্প নয়, এটি বাস্তব এবং এর প্রভাব ইতিমধ্যেই কর্মক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বে বহু প্রতিষ্ঠানে এখন কাজের গতি ও দক্ষতা বাড়াতে জেনারেটিভ এআই, রোবটিক প্রসেস অটোমেশন ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে। শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনের দিনের চাকরিতে এমন পরিবর্তন আসবে যা শিল্প বিপ্লবের পর দেখা গিয়েছিল – কিছু চাকরি হারিয়ে যাবে, আবার নতুন ধরণের কাজ তৈরি হবে। বিশ্বের শীর্ষ কোম্পানিগুলো কর্মীদের এআই-সংক্রান্ত দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিচ্ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ব্যবস্থাপকদের দুই-তৃতীয়াংশ (৬৬%) এখন এমন প্রার্থীকে চাকরি দিতে চান না যার এআই দক্ষতা নেই । এমনকি কম অভিজ্ঞ কিন্তু এআই-জানা প্রার্থীও বেশি অভিজ্ঞ অথচ এআই-অদক্ষ প্রার্থীর চেয়ে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে, আগামী দিনের প্রায় সব পেশাতেই এআই জ্ঞানের মূল্য অপরিসীম হবে।

তবে এআই এসেছে বলে যেন সব কাজ হারিয়ে যাবে – বিষয়টা সে রকম সরল নয়। অনেক কাজ এআই সরাসরি করে দিতে পারলেও মানুষের বিশ্লেষণী ক্ষমতা, সৃজনশীলতা ও নৈতিক বিবেচনার জায়গা এখনো অপরিহার্য। এআই একদিকে আমাদের কাজের পুনরাবৃত্তিমূলক অংশটুকু খুব দ্রুত করে দিতে পারে – যে কাজ মানুষকে মাসের পর মাস খেটে করতে হতো, সেখানে এআই মিনিটেই ফল দিতে সক্ষম – অন্যদিকে মানুষের দ্বারা সমাধানযোগ‍্য ও সৃজনশীল চিন্তার জায়গাটা ঠিকই খালি থাকে। এ কারণেই এআইকে হুমকি না ভেবে সহায়ক হাতিয়ার হিসেবে দেখা ভালো। যেমনটি এক তরুণ বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “এআইকে হুমকি হিসাবে নয়, বরং দক্ষতা বাড়ানোর একটি সরঞ্জাম হিসেবে দেখা উচিত”, এবং চাকরির বাজারে টিকে থাকতে আমাদের অবশ্যই নিজেদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। বলা হয়ে থাকে, এআই আপনার চাকরি নিয়ে নেবে না, বরং যে ব্যক্তি এআই ব্যবহার করতে জানে সে আপনার চাকরিটি নিয়ে নিতে পারে – এ কথাটিই বাস্তবতা হয়ে উঠছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতা: পিছিয়ে থাকার ঝুঁকি

বড় শক্তিগুলো যখন এআই উদ্ভাবনে ছুটছে, আমাদের বাংলাদেশ কী অবস্থায় আছে? সত্য বলতে, এআই দৌড়ে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে আছি। দেশের শিক্ষা ও কর্মব্যবস্থায় এখনো সনাতনী ধারা প্রবল; প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নে জোর কম। বাংলাদেশের বেশির ভাগ যুবক-যুবতীর ডিজিটাল দক্ষতা দুর্বল, এমনকি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে দেশের ৮৪% তরুণেরই এআই ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক ডিজিটাল দক্ষতা পর্যন্ত নেই । শুধু পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান মুখস্থ করে ভালো ফলাফল পেলেই ভবিষ্যতের চাকরির বাজারে লাভ হবে না। আজকের বিশ্বে তথ্য মুখস্থের চেয়ে তা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা অনেক বেশি দরকার। প্রথাগত ডিগ্রিধারী হয়েও যদি কেউ নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে না জানে, তবে চাকরি পাওয়া তো দূরে থাক, বর্তমান চাকরিটিও টিকে রাখা কঠিন হবে। প্রকৃতপক্ষে, পৃথিবী খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে এআইয়ের জোরে। এই গতির সঙ্গে যদি আমরা তাল মিলাতে না পারি, তাহলে অচিরেই ‘অপ্রাসঙ্গিক’ হয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে ।

বাংলাদেশে এআই-এর প্রভাব ইতিমধ্যে কিছু ক্ষেত্রে দেখা শুরু হয়েছে। আমাদের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক (গার্মেন্টস) শিল্পে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে, যার ফলে কর্মীদের উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোতে অটোমেশন চালুর ফলে কর্মীদের সংখ্যা গড়ে ৩০.৫৮% কমে গেছে। বিশেষ করে যেসব কর্মী অদক্ষ বা স্বল্প-দক্ষ ও যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ করতেন, তাঁদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়েছে। অধিকন্তু, এসব কারখানায় আধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে যা শ্রমিকদের উৎপাদনমাত্রা প্রতি মুহূর্তে পর্যবেক্ষণ করছে। ঢাকা’র একটি স্মার্ট পোশাক কারখানায় “নিডল” (No Idle) নামক ডিভাইসের স্ক্রিনে শ্রমিকের উৎপাদনগত তথ্য দেখা যায়, যা লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে লাল সংকেত দেখায়। এভাবে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি একদিকে উৎপাদন বাড়াচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অন্যদিকে অনেক শ্রমিক, বিশেষ করে নারীরা, মেশিনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে কর্মক্ষেত্র থেকে ছিটকে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের আউটসোর্সিং ও বিপিও (BPO) খাতেও এআই-এর আঘাত দেখা যাচ্ছে। অনেক বহুজাতিক কোম্পানি এখন বাংলাদেশ থেকে আউটসোর্স করা কাজও এআই দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। এক উদাহরণে দেখা গেছে, দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের মুনাফা রোজগারকারী একটি প্রকল্পে হঠাৎ ক্লায়েন্ট জানিয়ে দিল কাজটি আর মানুষের প্রয়োজন নেই – এআই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ সামলে দেবে, ফলে এক ধাক্কায় ওই প্রকল্পের ৮০% এর বেশি কর্মী কাজ হারালেন । ওই প্রকল্পে শতাধিক লোক $৮.৫০ ঘণ্টাপ্রতি মজুরিতে কর্মরত ছিল, যাদের প্রায় সবাই রাতারাতি বেকার হয়ে পড়েন। দেশের বিপিও অ্যাসোসিয়েশন (বাক্কো) বলছে, প্রায় ৮০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান থাকা এই খাতটি এখন বড় রকমের পরিবর্তনের মুখে। অনেক কোম্পানি টিকে থাকতে তাদের সাপোর্ট সেন্টার, ডেটা এন্ট্রি, গ্রাফিক ডিজাইন এমন নানা বিভাগে এআই টুল আনছে এবং লোকবল কমাচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠানে এআই-চালিত মাননিরীক্ষা (quality assurance) ব্যবস্থার কারণে দলের আকার ২০-৩০% পর্যন্ত কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এক শীর্ষ বিপিও প্রতিষ্ঠানের প্রধান বলছেন, “আমাদের ২৫০ জন কর্মী ছিল, এখন অটোমেশনের ফলে দেড়শ’তে নেমে এসেছে”। আবার অন্য এক স্টুডিও যা আগে ২৫ জন করে নতুন জনবল নিত, এখন এআই সফটওয়্যার ব্যবহারের ফলে ১০ জনের বেশি নিয়োগ দিতে হচ্ছে না, এবং এক বছরে তাদের কর্মীসংখ্যা ৬৫০ থেকে ৫৫০-তে নেমেছে। অবস্থাটা এমন যে “এআই সমাধান গ্রহণ করা বিলাসিতা নয়, বাঁচতে হলে এটি ব্যবহার করতেই হবে” বলে উদ্যোক্তারা মন্তব্য করছেন। এই বাস্তবতা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে বাংলাদেশও এআই ঝড়ের বাইরে নয়; বরং প্রস্তুতি না থাকলে আমাদের শিক্ষিত তরুণরাও চাকরির বাজারে সংকটে পড়বেন।

বদলের পথে করণীয়: এআইকে আপনা করুন, দক্ষতা বাড়ান

এতো কথা যখন এআই নিয়ে, তখন সমাধানের কথাও বলতে হবে। আমরা কি এআইকে ভয় পেয়ে প্রযুক্তিহীন থাকব, নাকি এটিকে হাতিয়ার বানিয়ে সামনে এগোব? ইতিহাস বলে, নতুন প্রযুক্তি এলেই শুরুতে ভয় জাগে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে মানুষ অভিযোজন করে নেয়। এআইও তার ব্যতিক্রম নয়। আসল কথা হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি শক্তিশালী হাতিয়ার, যা মানুষের জায়গা নিতে আসেনি বরং মানুষের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে এসেছে । তাই এআইকে শত্রু নয়, বন্ধুই ধরতে হবে।

বাংলাদেশের তরুণদের এখন সবচেয়ে বেশি দরকার নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানো – যাকে বলা হচ্ছে আপস্কিলিং। এর মানে সবাইকে গিয়ে মেশিন লার্নিং গবেষক হতে হবে না, বরং যার যার পেশায় এআই টুল বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে কাজের মান বাড়ানো শিখতে হবে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের পরামর্শ হচ্ছে, কর্মী ও শিক্ষার্থীদের এখন থেকেই এআই যুগের উপযোগী দক্ষতা শিখতে হবে। কেমন সেই দক্ষতা? প্রথমত ডিজিটাল সাক্ষরতা, অর্থাৎ কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও বিভিন্ন এআই চালিত সফটওয়্যার ব্যবহারে পারদর্শী হওয়া। দ্বিতীয়ত সমস্যা সমাধান ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা – জটিল পরিস্থিতিতে তথ্যকে কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারা। তৃতীয়ত সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী চিন্তা – যা এআই এখনও পারে না, কারণ মানবিক কল্পনা আর আবেগের গভীরতা কৃত্রিম ব্যবস্থায় অনুপস্থিত। চতুর্থত যোগাযোগ ও দলগত কাজের দক্ষতা – সহকর্মী ও ক্লায়েন্টের সঙ্গে কার্যকরভাবে ভাব বিনিময়, নেতৃত্ব দেওয়া, সহমর্মিতা দেখানো ইত্যাদি মানবিক গুণ, যা এআই দিয়ে প্রতিস্থাপন সম্ভব নয়। এছাড়া নতুন প্রযুক্তি দ্রুত শেখার মানসিকতা থাকতে হবে, কারণ পরিবর্তনের গতি অনেক বেশি।

নিম্নে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা সূচকের আকারে তুলে ধরা হলো, যেগুলো এআই যুগে বাংলাদেশের যুবকদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে শেখা জরুরি:
• ডিজিটাল ও এআই লিটারেসি: কম্পিউটার, প্রোগ্রামিংয়ের প্রাথমিক ধারণা এবং চ্যাটজিপিটি, জেমিনি, মাইক্রোসফ্ট কোপাইলটের মতো এআই টুল কীভাবে কাজে লাগাতে হয় সেটা শেখা।
• সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি: কোনো তথ্য পেলে সেটাকে যাচাই করা, প্রশ্ন করা এবং খুঁটিনাটি বিশ্লেষণ করার অভ্যাস গড়া। এআই কোনো উত্তর দিলে সেটাকে অন্ধভাবে গ্রহণ না করে নিজে বিচার-বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
• সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন: গতানুগতিক চিন্তার বাইরে গিয়ে নতুন সমাধান বের করা। এআই বর্তমান ডেটার ভিত্তিতে কাজ করে, তাই একদম নতুন আইডিয়া এবং মানসিক উৎকর্ষ মানুষের কাছ থেকেই আসবে।
• মানবিক যোগাযোগ ও আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা: মানুষের অনুভূতি বোঝা, দলবদ্ধভাবে কাজ করা, নেতৃত্ব দেওয়া, সুস্পষ্টভাবে নিজের ভাবনা প্রকাশ করা – এসব নৈপুণ্য যে প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের মধ্যে থাকবে, তারাই এআইকে সঙ্গে নিয়ে সফল হতে পারবে।
• আজীবন শেখার মানসিকতা: কলেজের পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান দিয়ে সারা জীবন চলবে না। প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে নিজের দক্ষতাও নিয়মিত আপডেট করতে হবে। নতুন কোর্স করা, অনলাইনে শেখা, কর্মস্থলে প্রশিক্ষণ নেওয়া – এসব করতে হবে পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই।

এখানে একটা কথা মনে রাখা জরুরি: বিদ্যালয়-কলেজে শুধু বইয়ের পড়া নয়, দলগত প্রকল্প, গবেষণা, বিতর্ক, সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমেও শিখতে হবে, কেননা এআই সাধারণ জ্ঞান দিতে পারলেও মানুষের মতো করে ভাবতে শিখতে সাহায্য করবে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন প্রয়োজন, যেখানে মুখস্ত বিদ্যার চেয়ে প্রচলিত সমস্যার নতুন সমাধান খোঁজার ওপর জোর থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা যেন শুধু সার্টিফিকেট অর্জন না করে, বাস্তব জ্ঞান ও সফট স্কিল অর্জন করে বের হতে পারে – এটা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এগিয়ে আসতে হবে প্রশিক্ষণে বিনিয়োগ করতে। এক বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন, “যদি সরকার দক্ষতা উন্নয়নে ভর্তুকি না দেয়, আমরা পিছিয়ে পড়ব”। সুতরাং জাতীয়ভাবে একটি মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা দরকার, যেখানে এআই যুগে কোন কোন দক্ষতায় জোর দেব তা স্পষ্ট থাকবে।

ভবিষ্যতের পথে আশা ও প্রস্তুতি

অবশ্যই চ্যালেঞ্জ আছে, তবে সবকিছু নেতিবাচক নয়। এআই অনেক নবীন উদ্যোক্তার জন্য নতুন দ্বারও খুলে দিচ্ছে। বাংলাদেশেই কিছু কোম্পানি এআই ব্যবহার করে নতুন সেবা (যেমন আর্থিক প্রতারণা শনাক্তকরণ, কৃষিতে ফসল পূর্বাভাস, স্বাস্থ্যপরামর্শ ইত্যাদি) চালু করছে। এআই যদি কিছু পুরনো কাজ কমিয়েও দেয়, নতুন উদ্ভাবনমূলক কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে। ভবিষ্যতে যেসব কাজ বের হবে তার বড় অংশই হয়তো আজ বিদ্যমান নেই – আগামীর বিশ্বে ৫০% এর বেশি দক্ষতা (skills) সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে, আর জেনারেটিভ এআই এসে এই পরিবর্তনের গতি আরও বাড়িয়ে ৬৮% পর্যন্ত করতে পারে । তাই আজ যে শিশু স্কুলে যাচ্ছে, দশ বছর পর হয়তো এমন পেশায় কাজ করবে যা এখনো আমরা কল্পনা করছি না।

এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও একটা কথা নিশ্চিত: যাঁরা পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের বদলাতে পারবেন, তারাই সফল হবেন। এআই একদিন হয়তো আমাদের বহু রুটিন কাজ করে দেবে, কিন্তু মানুষের চিন্তা, মেধা ও হৃদয়-বোধের জায়গাটা কখনো সম্পূর্ণ নিতে পারবে না। বাংলাদেশের তরুণদের মেধা ও উদ্যম বিশ্বখ্যাত। তাঁরা যদি সময় থাকতেই এআইকে আপন করে নেন, নতুন দক্ষতা অর্জনে মনোনিবেশ করেন, তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রতিযোগিতা করতে পারবেন। আর যারা আগ্রহী হবেন না, দুর্ভাগ্যবশত তাদের পেছনে পড়েই থাকতে হবে।

প্রথম শিল্পবিপ্লবে যারা বদল মেনে নিতে পারেনি, তারা পিছিয়ে গিয়েছিল, আর যারা খাপ খাইয়ে নিয়েছিল, তারাই নেতৃত্ব দিয়েছে। এআই যুগের বিপ্লবেও একই কথা প্রযোজ্য। এখনই সময় সাহস করে নতুনকে গ্রহণ করার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই ঢেউকে ভয়ের চোখে না দেখে জ্ঞানের আলোয় এগিয়ে গেলে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। আমাদের লক্ষ্য হোক এআই-কে দিয়ে মানুষের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে এক নতুন উন্নয়ন-গাথা রচনা করা, যেখানে প্রযুক্তি আর মানবসম্পদ মিলেই দেশকে সামনে নিয়ে যাবে।

সুতরাং, চাকরির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে, আসুন আমরা পরিবর্তনের প্রস্তুতি নেই। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ আর উদ্ভাবনের মাধ্যমে আমরা এআই যুগের চ্যালেঞ্জকে সুযোগে পরিণত করতে পারব। আজ যারা শিক্ষার্থী বা নবীন কর্মী, তাদের হাতেই বাংলাদেশের আগামী দিনের চাবিকাঠি। এআই আমাদের অনেক কাজ করবে ঠিকই, কিন্তু এর সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে পারলে লাভটা আমাদেরই – আর সেই লক্ষ্যেই এখন থেকে সচেষ্ট হওয়া দরকার। ভবিষ্যতের বাংলাদেশ হোক এমন এক স্মার্ট বাংলাদেশ, যেখানে মানুষের মেধা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হাত ধরাধরি করে অগ্রগতির পথে হাঁটবে।

শেষ কথা, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী – তাকে থামানো যায় না, তবে প্রস্তুতি নিয়েই এগিয়ে থাকা যায়। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের হাতেই: আমরা কি এআই-বিপ্লবের সহযাত্রী হব, নাকি পাশ দাঁড়িয়ে দেখব অন্যান্যরা আমাদের পেছনে ফেলে সামনে চলে যাচ্ছে? ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে – চলুন, আমরা সে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হই।

তথ্যসূত্র: পৃথিবীর শ্রমবাজারে এআই-এর প্রভাব সম্পর্কিত উপাত্ত ও বিশেষজ্ঞ উদ্ধৃতিগুলো বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন ও গণমাধ্যম থেকে সংগৃহীত, যথাক্রমে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, মাইক্রোসফট ও লিংকডইন সমীক্ষা, দ্য ডেইলি স্টার, প্রথম আলো ইত্যাদি জাতীয় পত্রিকার প্রতিবেদন এবং আন্তর্জাতিক জার্নাল/প্রতিবেদন। এসব সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে এই মতামত নিবন্ধটি রচিত হয়েছে।

২৩ আগস্ট ২০২৫


Discover more from LK INNOVATE

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment

Trending

Discover more from LK INNOVATE

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading