লিখেছেন: ড. লোকমান খান

বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেক স্কুলে বিজ্ঞান শিক্ষার চিত্রটি একরকম নিস্প্রাণ—একটি খোলা মাঠ, চারদিকে গ্রামীণ নির্জনতা, আর ক্লাসরুমে কিছু কৌতূহলী চোখ; কিন্তু নেই পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, নেই বিজ্ঞান ল্যাব, নেই সেইসব আতকে উঠার মত মুহূর্ত যা একেকটা বিজ্ঞান ক্লাসে ছাত্রছাত্রীদের চোখে জ্বেলে দেয় আগ্রহের আলো। মাকহাটি জি. সি. হাই স্কুলও এর ব্যতিক্রম নয়।

তবু আমি বিশ্বাস করি—‘বিজ্ঞান শেখা মানে শুধুই টেস্ট টিউব আর ব্যাকারেল ল্যাম্প নয়; এটা একধরনের কল্পনার খেলাও।’ আর এই কল্পনার মাঠে আজ আমরা নামতে পারি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI-এর হাত ধরে

মনে করুন, আপনার হাতে একটি স্মার্টফোন। সেই স্মার্টফোন দিয়েই আপনি ল্যাবে ঢুকে পড়লেন, যেখানে কাঁচের যন্ত্রপাতির ঠোকাঠুকি নেই, রাসায়নিকের গন্ধ নেই, কিন্তু সমস্ত পরীক্ষাগুলো আপনি নিজের হাতেই করছেন। এটাই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (AI)-এর জাদু। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাস করানো খুবই ব্যয়বহুল এবং কঠিন, সেখানে এই প্রযুক্তি হতে পারে এক নতুন দিশা।

আপনি কি কখনও ভেবে দেখেছেন, যদি আইনস্টাইনের পকেটে একটা স্মার্টফোন থাকতো তাহলে কী হতো? অথবা বাংলাদেশের কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের ক্লাসরুম যদি লন্ডনের আধুনিক ল্যাবের মতো বিজ্ঞান শিখতে পারতো?

আমাদের দেশের অনেক প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে বিজ্ঞানের ব্যবহারিক ক্লাসগুলো শুধু বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। শিক্ষক-শিক্ষিকারা প্রাণপণ চেষ্টা করেন, কিন্তু প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির অভাবে তা সম্ভব হয় না। এতে শিক্ষার্থীদের মনে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ জন্মায় না। তারা বিজ্ঞানকে জটিল ও নীরস বিষয় হিসেবে দেখে। এখানেই এআই-এর ভূমিকা।


ঠিক এইরকম কৌতূহল থেকেই আমার বন্ধু, এআই বিশেষজ্ঞ প্রফেসর আলমগীর হোসেন এবং আমি একটি বই লিখেছি, যার নাম ‘স্কুলে এআই’ (AI in School)। আমরা আশা করছি, এই বইটি ভবিষ্যতে বাংলাদেশের প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটি অপরিহার্য বই হয়ে উঠবে। আমরা ইতিমধ্যে কুমিল্লার এক গ্রামীণ স্কুলে কিছু পরীক্ষামূলক শিক্ষা কার্যক্রম করেছি, যেখানে আমরা দেখেছি কীভাবে একটা সাধারণ স্মার্টফোনও একটা ক্ষুদে বিজ্ঞানীর দূরবীন হয়ে উঠতে পারে। চোখে দেখেছি—জ্ঞান যখন হাতের মুঠোয় আসে, তখন চোখে উঠে আসে একরাশ বিস্ময়। এখন মাকহাটি জি. সি. উচ্চ বিদ্যালয়েও একই ধরনের কাজ করার স্বপ্ন দেখছি।

এই বইটিকে আমরা ভাবি এক ধরনের ডিজিটাল হ্যারিকেন হিসেবে—যা আলো ছড়াবে সেইসব ক্লাসরুমে, যেখানে এতদিন শুধু অন্ধকার আর অনাগ্রহ বাসা বেঁধে ছিল। আমরা স্বপ্ন দেখি এই বই একদিন বাংলাদেশের প্রতিটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিশ্বাসী সহচর হয়ে উঠবে—শুধু পাঠ্যবই হিসেবে নয়, বরং কৌতূহল আর কল্পনার একটি দরজা হিসেবে।

এখন আমি তাকিয়ে আছি মাকহাটী জি. সি. হাই স্কুল-এর দিকে। আমি আশাবাদী, এখানেও আমরা সেই একই কল্পনার বীজ বুনতে পারবো। সঠিক দিকনির্দেশনা আর একটু সাহস পেলে, একটি গ্রামের স্কুলও হয়ে উঠতে পারে বিজ্ঞানের এক উন্মুক্ত নীল আকাশ। কারণ যখন আপনি একটি কিশোরের হাতে কৌতূহলের চাবি তুলে দেন, তখন একটি স্মার্টফোনও হয়ে উঠতে পারে একটি রকেটশিপ—জ্ঞান, কল্পনা ও সম্ভাবনার মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার জন্য।

বিজ্ঞান ল্যাব এখন হাতের মুঠোয়!

এআই সিমুলেশন ব্যবহার করে আমরা বাস্তব পরীক্ষা-নিরীক্ষার একটি ডিজিটাল সংস্করণ তৈরি করতে পারি। এর জন্য দামি ল্যাবরেটরি বা যন্ত্রপাতির দরকার নেই। শুধু দরকার একটি স্মার্টফোন আর মোটামুটি মানের ইন্টারনেট সংযোগ। শিক্ষার্থীরা তাদের স্মার্টফোনে একটি অ্যাপের মাধ্যমে বা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করতে পারবে।

আমরা সবাই জানি, একটি পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞান ল্যাব তৈরির জন্য প্রয়োজন অনেক অর্থ, স্থান, এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল। অথচ একটি স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই এখন আমরা স্কুলের ক্লাসরুমকে পরিণত করতে পারি ভার্চুয়াল বিজ্ঞান ল্যাবে।

আমাদের লেখা বই ‘স্কুলে এআই’ (AI in School)-তে আমরা দেখিয়েছি কিভাবে সাশ্রয়ী প্রযুক্তি দিয়েই শিক্ষার্থীরা শিখতে পারে পদার্থ, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের মজার ও বাস্তবসম্মত পাঠ।

কীভাবে একটি স্মার্টফোনে বিজ্ঞান শেখা সম্ভব?

চলুন কিছু বাস্তব উদাহরণ দেখি যা মাকহাটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারে—

১. ভার্চুয়াল রসায়ন ল্যাব (Chemistry Lab Simulation)

অ্যাপ: Chemistry Lab AR, Labster, PraxiLabs

কী শেখা যাবে:

  • লবণ ও অ্যাসিড মেশালে কী হয়?
  • pH স্কেল কীভাবে কাজ করে?
  • কীভাবে একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে?
  • লবণাক্ত পানির তড়িৎ বিশ্লেষণ: শিক্ষার্থীরা একটি ভার্চুয়াল বিকারে লবণাক্ত পানি নিয়ে তাতে দুটি ইলেকট্রোড প্রবেশ করাবে। তারা স্মার্টফোনের স্ক্রিনে দেখবে কীভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহের ফলে সোডিয়াম ও ক্লোরিন গ্যাস আলাদা হচ্ছে। তারা নিজের হাতে ভোল্টেজ বা কারেন্টের মাত্রা পরিবর্তন করে দেখতে পারবে এর কী প্রভাব পড়ে।
  • pH মাত্রা নির্ণয়: একটি এআই সিমুলেশন অ্যাপের সাহায্যে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন পদার্থের (যেমন, লেবুর রস, সাবানের পানি, ইত্যাদি) pH মাত্রা নির্ণয় করতে পারবে। তারা ভার্চুয়াল pH পেপার ব্যবহার করে এর রঙ পরিবর্তন দেখতে পাবে এবং ডিজিটালভাবে মান নির্ণয় করতে পারবে।

উপকারিতা:
এই অভিজ্ঞতা বাস্তব ল্যাবের মতোই, তবে কোনো দাহ্য পদার্থ বা গ্লাসওয়্যার প্রয়োজন নেই!

২. পদার্থবিদ্যার ভার্চুয়াল পরীক্ষা (Physics Simulation Apps)

অ্যাপ: PhET Interactive Simulations, Physics Toolbox, PocketLab

উদাহরণ:

  • একটি ভার্চুয়াল দোলনা তৈরি করে নিউটনের গতিসূত্র শেখা
  • ওহমের সূত্র প্রয়োগ করে ভার্চুয়াল সার্কিট বোর্ড তৈরি
  • ভেক্টর এবং বলের ব্যাখ্যা ৩D অ্যানিমেশন দিয়ে
  • নিউটনের গতিসূত্র: শিক্ষার্থীরা একটি ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে বিভিন্ন ভরের বস্তুকে বিভিন্ন গতিতে ছুড়ে দেখতে পারবে। তারা বুঝতে পারবে কীভাবে ভর এবং গতির মধ্যে সম্পর্ক আছে। নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র F=ma (বল = ভর \times ত্বরণ) তারা বাস্তবে দেখতে পাবে।
  • সার্কিট তৈরি: একটি অ্যাপের মধ্যে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধরনের রোধ (resistance), ব্যাটারি এবং সুইচ ব্যবহার করে একটি বৈদ্যুতিক সার্কিট তৈরি করতে পারবে। তারা দেখতে পাবে কীভাবে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে এবং কী কী সমস্যা হতে পারে।

৩. জীববিজ্ঞানের ভার্চুয়াল ল্যাব (Biology Lab Simulations)

অ্যাপ: BioDigital Human, Cell World, Anatomy Learning

যেমন:

  • হৃৎপিণ্ড কিভাবে রক্ত পাম্প করে তা ৩D অ্যানিমেশনে দেখা
  • কণিকা ও কোষের গঠন অনলাইন মডেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শেখা
  • প্ল্যান্ট ট্রান্সপিরেশন এক্সপেরিমেন্ট মোবাইলেই করা
  • উদ্ভিদ কোষের গঠন: শিক্ষার্থীরা একটি ভার্চুয়াল মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে একটি উদ্ভিদ কোষের ভেতরের অংশ দেখতে পাবে। তারা কোষ প্রাচীর, সাইটোপ্লাজম, নিউক্লিয়াস, ইত্যাদি চিহ্নিত করতে পারবে এবং তাদের কাজ সম্পর্কে জানতে পারবে
  • ডিএনএ (DNA) এর গঠন: একটি সিমুলেশন অ্যাপে শিক্ষার্থীরা ডিএনএ-এর ডাবল হেলিক্স গঠন তৈরি করতে পারবে। তারা দেখতে পাবে কীভাবে নিউক্লিওটাইডগুলো একে অপরের সাথে সংযুক্ত হয়ে ডিএনএ তৈরি করে।

লক্ষ্য: মাকহাটী জি. সি. হাই স্কুলে প্রযুক্তিনির্ভর বিজ্ঞান ক্লাস

আমার স্বপ্ন, মাকহাটি স্কুলেও আমরা চালু করবো এমন ডিজিটাল বিজ্ঞান পাঠ, যেখানে শিক্ষার্থীরা:

  • বাস্তব জিনিস ছোঁয়া না গেলেও অনুভব করতে পারবে
  • বইয়ের পাতার বাইরে বের হয়ে ভাবতে পারবে
  • নিজের হাতে স্মার্টফোনে পরীক্ষা চালিয়ে বিজ্ঞান শেখার আনন্দ পাবে

শুধু ছাত্রছাত্রীরাই নয়, শিক্ষকদের জন্যেও আমরা পরিকল্পনা করছি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ, যাতে তারা সহজেই ক্লাসে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারেন।

আশার কথা: কল্পনা থেকেই সৃষ্টি, আর সৃষ্টি থেকেই পরিবর্তন

আমরা জানি, কল্পনাই মানুষের সবচেয়ে বড় শক্তি। একটা ছোট স্মার্টফোন আর একটু ইন্টারনেট দিয়েই গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের বিজ্ঞানী। যেমন একটা ছোট বীজ থেকে গাছ, তেমনি একটি ছোট অ্যাপ থেকেও জন্ম নিতে পারে বিশাল একটি সম্ভাবনা।

আমার বিশ্বাস, ‘স্কুলে এআই’ বইটি একদিন বাংলাদেশের প্রতিটি স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। আর মাকহাটি জি. সি. হাই স্কুল হবে সেই পথচলার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এআই ভিত্তিক এই শিক্ষা পদ্ধতি বিজ্ঞান শিক্ষাকে আরও সহজ, আনন্দদায়ক এবং অর্থবহ করে তুলবে। শিক্ষার্থীরা নিজে হাতে ভার্চুয়াল পরীক্ষাগুলো করার সুযোগ পাবে, যা তাদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরি করবে এবং শেখার প্রক্রিয়াকে আরও মজাদার করে তুলবে। এটি শিক্ষার্থীদের শুধুমাত্র জ্ঞান অর্জন করতে সাহায্য করবে না, বরং তাদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসু মন এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাও বৃদ্ধি করবে। মাকহাটি জি. সি. হাই স্কুলের মতো স্কুলগুলোতে এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা একটি মডেল হিসেবে কাজ করবে, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অন্য সব প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষার মান উন্নয়নে সাহায্য করবে। আমরা আশা করি, এআই-এর হাত ধরে বিজ্ঞানের এক নতুন যুগ শুরু হবে, যেখানে কোনো শিক্ষার্থীই শুধু প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না।

শেষ কথা: মাকহাটী স্কুলের শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান

প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ, আপনারা যদি চান আপনাদের ছাত্রছাত্রীরা বিজ্ঞানকে ভয় না পেয়ে ভালোবাসুক, তাহলে চলুন আমরা একসাথে এই ডিজিটাল ল্যাবের পথচলা শুরু করি।


আমরা প্রস্তুত আছি সহযোগিতা করতে—আপনারা শুধু আগ্রহ দেখান।

বিজ্ঞান মানে শুধু সূত্র নয়, বিজ্ঞান মানে কল্পনা, অনুসন্ধান, আর একটু সাহস। আর সেই সাহস আপনাদের হাতেই আছে।


Discover more from LK INNOVATE

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment

Trending

Discover more from LK INNOVATE

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading