লেখক ও বিশ্লেষক: ড. লোকমান খান
সাম্প্রতিক ইরান-ইসরায়েল সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে এক নতুন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যগুলো আরও বেশি রহস্যময় এবং উদ্বেগজনক মনে হচ্ছে। জি৭ সম্মেলন থেকে আকস্মিক প্রস্থান এবং এরপর এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের কাছে তার বক্তব্য— “আমরা যুদ্ধবিরতির চেয়েও ভালো কিছু খুঁজছি,” “একটি বাস্তব সমাপ্তি,” এবং “একটি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ” — এসবই গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। একই সাথে, তেহরানের বাসিন্দাদের “অবিলম্বে শহর ছেড়ে সরে যেতে” বলার পেছনে কী উদ্দেশ্য নিহিত, তা নিয়েও আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা চলছে।
প্রথমেই প্রশ্ন আসে, ট্রাম্পের এই মন্তব্যগুলো কি পরোক্ষভাবে জড়িত যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি সংঘাতে জড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে? যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ করে পরোক্ষভাবে এই সংঘাতে জড়িত। কিন্তু “যুদ্ধবিরতির চেয়েও ভালো কিছু” চাওয়া কি কেবল অস্ত্র সরবরাহ বা রাজনৈতিক সমর্থনের বাইরে গিয়ে সামরিক হস্তক্ষেপে ইশারা করছে? “একটি বাস্তব সমাপ্তি” বলতে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন? এটি কি ইরানের সামরিক সক্ষমতার সম্পূর্ণ বিনাশ, নাকি শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন? এই অস্পষ্টতা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে।
সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক হলো ট্রাম্পের “Everyone should immediately evacuate Tehran!” মন্তব্যটি। তেহরান প্রায় ১ কোটি জনসংখ্যার একটি বিশাল শহর। এই ধরনের একটি মন্তব্য চরম একটি হুমকির মতো শোনাচ্ছে, যা গাজায় চলমান পরিস্থিতির সাথে তুলনা করা যায়, অথবা তার চেয়েও ভয়াবহ কিছু, যেমন কৌশলগত পারমাণবিক হামলার মতো ইঙ্গিত। যদিও সরাসরি পারমাণবিক হামলার কথা বলা হয়নি, “সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ” এবং “একটি বাস্তব সমাপ্তি”র মতো শব্দবন্ধগুলো হিরোশিমা-নাগাসাকির ভয়াবহ স্মৃতিকে উস্কে দিচ্ছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ থাকলেও, এই ধরনের চরম বাক্য প্রয়োগের পেছনের উদ্দেশ্য কী? এটি কি কেবল ইরানকে আলোচনার টেবিলে আনার জন্য চরম চাপ সৃষ্টি, নাকি সামরিক পদক্ষেপের চূড়ান্ত ইঙ্গিত?
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের সাথে তার জি৭ সম্মেলনের আকস্মিক প্রস্থান এবং পরে ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তার পোস্ট — যেখানে তিনি বলেন ইরানকে তার প্রস্তাবিত চুক্তি মেনে নেওয়া উচিত ছিল — সবকিছুই একটি জটিল চিত্র তুলে ধরছে। তিনি একদিকে “আলোচনায় খুব বেশি মেজাজে নেই” বলছেন, আবার অন্যদিকে ইরানকে “সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ” করার দাবি জানাচ্ছেন। এই দ্বিচারিতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
ট্রাম্পের এই “হিরোশিমা/নাগাসাকি revisited” ধরনের rhetoric একটি স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে: যুক্তরাষ্ট্র এই সংঘাতের একটি চূড়ান্ত সমাধান চায়, যা ইরানের জন্য অত্যন্ত কঠোর হবে। এটি কি ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার প্রচেষ্টা, নাকি আরও বিস্তৃত ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্যের অংশ? এই প্রশ্নগুলো বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে এমনিতেই অস্থিরতা চরমে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের তীব্রতা বাড়লে তা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুতর হুমকি হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রভাবশালী নেতার অস্পষ্ট এবং উস্কানিমূলক মন্তব্যগুলো কেবল সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই মন্তব্যের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করা এবং এমন কোনো পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া যা এই সংঘাতকে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে, যার পরিণতি হবে অকল্পনীয়।
১৭ জুন ২০২৫






Leave a comment