ড. লোকমান খান

যুক্তরাজ্য – আধুনিকতা, স্বাধীন মত প্রকাশ ও মানবাধিকারের প্রতীক – এমন একটি দেশেও বেশ্যাবৃত্তি আইনত নিষিদ্ধ। কেন? এর পেছনে আছে সমাজ রক্ষার গভীর চিন্তা, মূল্যবোধ ও মানবিক ব্যাখ্যা। এসব যুক্তি বিশ্লেষণে এখন না-ই গেলাম। তবে এটুকু বোঝা জরুরি – যে দেশ সর্বোচ্চ ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার দেয়, সেই দেশেও কিছু জিনিস আইনি অধিকার নয়

এমন বাস্তবতায়, ৯১ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে যখন নারী সমতার নামে বেশ্যাবৃত্তিকে আইনসিদ্ধ করার আন্দোলন শুরু হয়, তখন প্রশ্ন জাগে – এটি কি অধিকার আদায়ের প্রকৃত চেষ্টা, না কি আমাদের সমাজের মূল কাঠামোকে ধ্বংস করার একটি সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা?


সমাজ মানেই মূল্যবোধ

প্রতিটি সমাজের একটি নিজস্ব পরিচয় থাকে। সেই পরিচয় গড়ে ওঠে ধর্ম, জাতিগোষ্ঠী, ঐতিহ্য ও সামাজিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের সমাজ কাঠামোর মধ্যে থেকেই নিজেদের অধিকারের সংজ্ঞা ঠিক করে। তাই পশ্চিমের নারীরাও বেশ্যাবৃত্তিকে অধিকার হিসেবে দাবি করেন না, কারণ তারা জানেন – এতে সমাজের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস হবে।

বাংলাদেশেও আমাদের সমাজের পরিচয় ইসলামি মূল্যবোধ, পারিবারিক সম্পর্ক এবং মানবিক সংবেদনশীলতার উপর দাঁড়িয়ে আছে। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই নারী অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।


সমতা (Equality) বনাম ন্যায়সঙ্গততা (Equity)

অনেকেই মনে করেন নারী অধিকার মানেই পুরুষের মতো সবকিছু চাইতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা ও নৈতিকতা বলে — সমতা আর ন্যায়সঙ্গততা এক বিষয় নয়

✅ সমতা (Equality):

সমতা হলো – সবাইকে সমান কিছু দেওয়া। এতে ব্যক্তিগত প্রেক্ষাপট, বাধা বা চাহিদা বিবেচনা করা হয় না।

উদাহরণ: একজন ধনী ও গরিব ছাত্রকে একই বই দেওয়া হলো। এটা সমতা। কিন্তু গরিব ছাত্রটির হয়তো খাবারই নেই, পড়বে কীভাবে?

✅ ন্যায়সঙ্গততা (Equity):

ন্যায়সঙ্গততা হলো – যার যা প্রয়োজন, সেটাই তাকে দেওয়া, যাতে সে প্রতিযোগিতায় সমানভাবে অংশ নিতে পারে।

উদাহরণ: গরিব ছাত্রকে বইয়ের পাশাপাশি খাবার, টিউশনও দেওয়া হলো। এটা ন্যায়সঙ্গততা।


বাংলাদেশে নারীর অবস্থান এবং বাস্তব প্রশ্ন

বাংলাদেশের নারীরা পিছিয়ে আছে – এটা সত্য। কিন্তু তাই বলে তারা যদি “সমতা”র নাম করে সবকিছু একসাথে চাওয়ার দাবি তোলেন, তাহলে কি তারা বাস্তব অর্থে লাভবান হবেন?

👉 আজ যদি নারীরা পুরুষের মতো সমান কাজ করেন, কিন্তু নিরাপত্তা পান না – তবে সেই সমতা অর্থহীন।
👉 যদি নারী কর্মজীবী হবার স্বাধীনতা পান, কিন্তু মাতৃত্বের সময় ছুটি না পান – তবে সেটাও সমতা নয়, নিপীড়ন।

তাই নারীর জন্য ন্যায়সঙ্গত সুযোগ ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরিই হওয়া উচিত মূল লক্ষ্য।


কে কার আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে?

বর্তমানে কিছু তথাকথিত “সুশীল” গোষ্ঠী এমন কিছু দাবিকে নারীর অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছে, যা আদতে নারীর প্রকৃত অধিকার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে

যেমন:

  • বেশ্যাবৃত্তিকে অধিকার হিসেবে তুলে ধরা
  • ফ্রি সেক্স বা তথাকথিত যৌন স্বাধীনতার নামে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা

এসব দাবি বাস্তবতা ও মূল্যবোধ বিবর্জিত। এসব দিয়ে কেউ হয়তো নারীর প্রতি সমাজের সহানুভূতি কমিয়ে দিতে চাইছে। এটি নারীবাদের বিরুদ্ধেই একটি সাবোটাজ


ইসলাম ও নারীর মর্যাদা

অনেকে বলেন, ইসলাম নারীকে পিছিয়ে রেখেছে। কিন্তু এটা সত্য নয়।

👉 ইসলাম নারীর উপার্জন, সম্পত্তির মালিকানা, শিক্ষা, মতপ্রকাশ, এমনকি রাজনীতি পর্যন্ত অংশগ্রহণের অধিকার দিয়েছে।

সমস্যা হয়েছে তখন, যখন সমাজের কিছু গোষ্ঠী ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে নারীদের দমন করেছে। দোষ ইসলাম বা ধর্মের নয়, দোষ সেই মানুষগুলোর।


শেষ কথা

বাংলাদেশের নারী আন্দোলনকে যদি এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে তা করতে হবে –

  • সমাজের বাস্তবতা বুঝে
  • ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সম্মান দিয়ে
  • অধিকারের নামে বিকৃতি না এনে

সমতা নয়, এখন দরকার ন্যায়সঙ্গততা।
আর অধিকার নয়, চাই মর্যাদা।


✍️ লেখক:
বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ, একজন চিন্তাশীল বাংলাদেশি নাগরিক, যিনি বিশ্বাস করেন – সমাজ বদলায় তখনই, যখন পরিবর্তনের ভাষা হয় মূল্যবোধ, ন্যায়সঙ্গততা ও মমতার।


পাঠকদের উদ্দেশ্যে:
আপনার মতামত, দ্বিমত বা সংযোজন থাকলে কমেন্টে জানান। যুক্তিনির্ভর আলোচনা আমাদের সবাইকে সমৃদ্ধ করে।


Discover more from LK INNOVATE

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment

Trending

Discover more from LK INNOVATE

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading