ড. লোকমান খান, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ
আমাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসংখ্য কোষ দিয়ে তৈরি। বার্ধক্যের মূল কারণ হলো, এই কোষগুলোর ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং পুনর্জন্মের হার কমে যাওয়া। বার্ধক্য জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, তবে আমরা অনেক সময় লক্ষ্য করি যে, কেউ তুলনামূলকভাবে কম বয়সী দেখায়, আবার কেউ দ্রুত বার্ধক্যের ছাপ ফেলে। জেনেটিক কারণের বাইরে এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হলো পরিবেশগত প্রভাব। আমাদের চারপাশের বাতাস, খাদ্য, দূষণ, সূর্যালোক এবং জীবনযাত্রার ধরন প্রত্যক্ষভাবে আমাদের শরীরের কোষ, ত্বক এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ওপর প্রভাব ফেলে। আজ আমরা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বুঝব কীভাবে পরিবেশ আমাদের বার্ধক্যকে ত্বরান্বিত করে এবং এর প্রতিকার কী হতে পারে।
১: ফ্রি র্যাডিক্যাল (Free Radicals) এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস (Oxidative Stress)
🔎 ফ্রি র্যাডিক্যাল কী?
ফ্রি র্যাডিক্যাল হলো এমন কিছু অণু বা পরমাণু, যেগুলোর বাইরের ইলেকট্রন শেল অসম্পূর্ণ থাকে। ইলেকট্রন সবসময় জোড়ায় থাকতে চায়। তাই ফ্রি র্যাডিক্যাল আশেপাশের সুস্থ অণু থেকে ইলেকট্রন ছিনিয়ে নেয়, যা আশেপাশের কোষের ক্ষতি করে। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় অক্সিডেটিভ স্ট্রেস।
👉 উদাহরণ:
একটি আপেল কেটে রাখলে কিছুক্ষণ পর এটি বাদামী হয়ে যায়। এটি মূলত অক্সিজেনের সঙ্গে ফ্রি র্যাডিক্যাল বিক্রিয়া করার ফল। ত্বকের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে, যা বয়সের ছাপ হিসেবে প্রকাশ পায়।
👉 কোষে কীভাবে ক্ষতি করে?
ফ্রি র্যাডিক্যাল আশেপাশের কোষের DNA, প্রোটিন এবং লিপিড (চর্বি) থেকে ইলেকট্রন ছিনিয়ে নেয়। এতে কোষের গঠন দুর্বল হয়ে যায় এবং কোষ দ্রুত মরে যায়।
- ত্বকে বলিরেখা এবং ডার্ক স্পট তৈরি হয়।
- চুল পড়া এবং দ্রুত সাদা হওয়া।
- হৃদপিণ্ড, কিডনি এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দুর্বল হয়ে পড়ে।
🔎 ফ্রি র্যাডিক্যাল কিভাবে তৈরি হয়?
ফ্রি র্যাডিক্যাল প্রাকৃতিকভাবে আমাদের শরীরে তৈরি হয়। তবে কিছু বাহ্যিক কারণেও এর উৎপাদন বেড়ে যায়:
🚗বায়ু দূষণ: গাড়ির ধোঁয়া, কল-কারখানার নির্গত গ্যাস।
☢️UV রেডিয়েশন: সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি সরাসরি ত্বকের কোলাজেন ভেঙে দেয়।
🚬🍷ধূমপান ও অ্যালকোহল: শরীরের কোষে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ায়।
🍔অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: প্রসেসড ফুড, অতিরিক্ত চিনি এবং ট্রান্স ফ্যাট।
😰মানসিক চাপ: স্ট্রেস হরমোন (Cortisol) বাড়ায়, যা কোষকে দুর্বল করে।
🔎 অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট (Antioxidants) কীভাবে কাজ করে?
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হলো এমন কিছু যৌগ, যা ফ্রি র্যাডিক্যালের প্রভাব থেকে আমাদের কোষকে রক্ষা করে। অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট স্বেচ্ছায় তাদের ইলেকট্রন দিয়ে ফ্রি র্যাডিক্যালকে স্থিতিশীল করে।
👉 উদাহরণ:
- ভিটামিন C → কমলা, লেবু, আমলকি
- ভিটামিন E → বাদাম, সূর্যমুখীর তেল
- বিটা-ক্যারোটিন → গাজর, কুমড়া, পালং শাক
- সেলেনিয়াম → ডিম, ব্রাজিল নাট, সামুদ্রিক খাবার
ফ্রি র্যাডিক্যাল (অস্থিতিশীল) + অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট (ইলেকট্রন প্রদানকারী) → স্থিতিশীল অণু
ফলাফল: ত্বক উজ্জ্বল থাকে, বলিরেখা দেরিতে আসে, হৃদরোগ এবং স্নায়ুবিক ক্ষতি কমে।
২: ইনফ্লামেশন (Inflammation) বা প্রদাহ
🔎 প্রদাহ কী?
প্রদাহ হলো আমাদের দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। যখন কোনো আঘাত বা ইনফেকশন হয়, তখন দেহ সেই জায়গায় রক্তের প্রবাহ বাড়ায় এবং শ্বেত রক্তকণিকা (White Blood Cells) পাঠায়।
তবে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ (Chronic Inflammation) বিপজ্জনক।
- দূষিত পানি ও খাদ্যগ্রহণ,
- ধূমপান ও অ্যালকোহল,
- মানসিক চাপ,
- অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার—এইসব কারণে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ তৈরি হয়।
🔎 দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ কীভাবে ক্ষতি করে?
- কোষের পুনর্জন্ম বাধাগ্রস্ত হয়: নতুন কোষ তৈরি ধীর হয়ে যায়।
- টিস্যু ভাঙনের হার বাড়ে: ত্বক শুষ্ক ও কুচকানো হয়ে পড়ে।
- অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ক্ষতি: হার্ট, কিডনি, এবং যকৃত দুর্বল হয়ে যায়।
- মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব: মস্তিষ্কের নিউরনে প্রদাহ হলে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়।
৩: এপিজেনেটিক পরিবর্তন (Epigenetic Changes)
🔎 এপিজেনেটিক কী?
আমাদের শরীরের প্রতিটি কোষে DNA থাকে, যা আমাদের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে। তবে সব জিন সক্রিয় থাকে না। “এপিজেনেটিক” হলো সেই প্রক্রিয়া যেখানে পরিবেশ, খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা এবং স্ট্রেস আমাদের জিনের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।
👉 সহজ উদাহরণ:
একই বীজ দুটি ভিন্ন পরিবেশে রোপণ করলে, একটির গাছ বড় হয়, অন্যটি ছোট থাকে। যদিও DNA একই, পরিবেশের প্রভাব দুই গাছকে ভিন্নভাবে বৃদ্ধি করে।
🔎 এপিজেনেটিক কীভাবে কাজ করে?
- DNA মিথাইলেশন (DNA Methylation): কিছু রাসায়নিক উপাদান DNA-এর ওপরে “মিথাইল গ্রুপ” যোগ করে, যা কিছু জিনকে নিষ্ক্রিয় করে।
- হিস্টোন মডিফিকেশন (Histone Modification): DNA যেসব প্রোটিনে পেঁচানো থাকে, তাদের গঠন পরিবর্তিত হয়।
ফলাফল:
- দূষণ এবং ধূমপান DNA-এর কিছু অংশ স্থায়ীভাবে পরিবর্তিত করে।
- ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- পরবর্তী প্রজন্মেও এই প্রভাব থাকতে পারে।
৪: টেলোমিয়ার (Telomere) ক্ষয় এবং কোষের বার্ধক্য
🔎 টেলোমিয়ার কী?
টেলোমিয়ার হলো ক্রোমোজোমের শেষ প্রান্তে থাকা প্রোটেকটিভ ক্যাপ। এটি ক্রোমোজোমকে সুরক্ষিত রাখে এবং কোষ বিভাজনের সময় ক্ষয় থেকে রক্ষা করে।
👉 বয়স বাড়ার সাথে টেলোমিয়ার ছোট হয়।
- দূষণ, UV রেডিয়েশন এবং মানসিক চাপ এই ক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে।
- টেলোমিয়ার যত দ্রুত ছোট হয়, তত দ্রুত কোষ বার্ধক্যের দিকে ধাবিত হয়।
পরিবেশগত দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায়:
✅ অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খান:
- টমেটো, পালং শাক, গাজর, বেরি ফল (Blueberry, Strawberry)।
- সবুজ চা ও বাদাম।
✅ পর্যাপ্ত পানি পান করুন:
- শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের হয়ে যাবে।
- ত্বক হাইড্রেটেড থাকবে।
✅ সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন:
- UV রশ্মির ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে এটি অত্যন্ত জরুরি।
✅ মানসিক চাপ কমান:
- নিয়মিত মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম করুন।
- প্রতিদিন অন্তত ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমান।
✅ ধূমপান ও অ্যালকোহল থেকে বিরত থাকুন:
- এগুলো ত্বক ও হৃদযন্ত্রকে মারাত্মক ক্ষতি করে।






Leave a comment