ড. লোকমান খান, বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ
(বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য)

ভূমিকা

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমরা প্রায়ই সিদ্ধান্ত নিই—“সকাল ছয়টায় উঠব, ফজরের নামাজের পর জগিং করব, পড়াশোনা শেষ করব, স্বাস্থ্যকর নাশতা খাব।” কিন্তু অ্যালার্ম বেজে উঠলেই আঙুলটা যেন নিজে থেকেই “স্নুজ” বোতামে চলে যায়! সমস্যাটা ইচ্ছাশক্তির ঘাটতি নয়; আসল সমস্যা হল মস্তিষ্কের একটি স্বয়ংক্রিয় সার্কিট—অভ্যাস লুপ। যা যুগে যুগে আমাদের সময়, শক্তি ও মনোযোগ বাঁচিয়ে এসেছে, এখন একই প্রক্রিয়া আমাদের লক্ষ্যে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুখবর হল—এই লুপ আপনি ইচ্ছেমতো রি‑প্রোগ্রাম করতে পারেন।


১. হুক ও প্রিমাইস

একটু কল্পনা করুন। রাত ১১টা, মোবাইলে অ্যালার্ম সেট করছেন: “৬:০০ এএম—রানিং!” ঘুম ভাঙতেই প্রথম শব্দ—ট্রিং ট্রিং ট্রিং! চোঁখ আধ‑বোজা অবস্থায় মনে পড়ল, দৌড়াতে যেতে হবে। কিন্তু অবচেতন মস্তিষ্ক—যে বহু বছর ধরে জেনে এসেছে, “ভোরের ঠান্ডা = কম্বলের নীচে আরাম”—চট করে স্নুজ বোতামে চাপ দিয়ে দেয়। এখানে কোনো নৈতিক ব্যর্থতা নেই; কেবল “কিউ‑রুটিন‑রিওয়ার্ড” (ইশারা‑কর্ম‑পুরস্কার) লুপ নিজের কাজ করেছে। এই নিবন্ধে শিখবেন, কীভাবে সেই লুপকেই কাজে লাগিয়ে মস্তিষ্ককে “ফাঁকি” দিয়ে ভাল অভ্যাস গড়ে তোলা যায়, আর খারাপ অভ্যাসকে বিদায় জানানো যায়।


২. অভ্যাস ১০১—সহজ ভাষায় স্নায়ুবিজ্ঞান

ক. অভ্যাস লুপ

প্রতিটি অভ্যাসের শুরুতে থাকে কিউ—কোনো ইশারা বা ঘটনার আভাস। তার পর রুটিন—আপনার স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া। শেষে রিওয়ার্ড—শরীর‑মন যা‑ই হোক কোনো সুফল বা তৃপ্তি পায়। উদাহরণস্বরূপ, ঈদের বাজারের গলি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন (কিউ), বাতাসে জিলাপির মিষ্টি ঘ্রাণ। আপনি কিনে খেতে শুরু করলেন (রুটিন) এবং মধুর স্বাদ ও বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগির আনন্দ পেলেন (রিওয়ার্ড)। ঠিক এভাবেই ছোটখাটো কিউ থেকে শক্তিশালী “খেয়ে ফেলি” অভ্যাস গড়ে ওঠে।

খ. ডোপামিন ও ভবিষ্যদ্বাণী

অনেকেই ভাবেন পুরস্কার পেলেই ডোপামিন বাড়ে। প্রকৃতপক্ষে, ডোপামিনের বড় অংশ নিঃসৃত হয় অপেক্ষা বা প্রত্যাশার সময়ে। যখন কিউ‑টি মস্তিষ্ককে ইঙ্গিত দেয়—“মজা আসছে!”—তখনই রসায়ন তৈরি হয়, যা আপনাকে তাত্ক্ষণিক রুটিনে ঠেলে দেয়। তাই পুরস্কারের আগে‑পরে কিউ‑র মানে বদলালেই অভ্যাস পাল্টাতে সুবিধা হয়।

গ. বেসাল গ্যাংলিয়া—মস্তিষ্কের “অটো‑পাইলট”

মানুষের প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স জটিল কাজ করে, কিন্তু শক্তি‑খরচও বেশি। তাই সহজ, পুনরাবৃত্তিমুলক কাজগুলো বেসাল গ্যাংলিয়ায় “সংরক্ষিত” হয়ে যায়—যাতে চিন্তা না‑করেই করা যায়। একবার পথ তৈরি হলে মস্তিষ্ক আর বাড়তি ক্যালরি নষ্ট করতে চায় না। এই কারণে পুরোনো অভ্যাস ভাঙতে শক্তি লাগে, আবার নতুন অভ্যাস তৈরি হলেও সেটা স্থায়ী হয়।

ঘ. নিউরোপ্লাস্টিসিটি উইন্ডো

প্রতিদিন পুনরাবৃত্তি আর সামান্য আবেগের ছোঁয়ায় নিউরোনের মাঝে নতুন সিন্যাপ্স গড়ে উঠে, পুরোনোটা দুর্বল হয়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা যায়, অভ্যাসকে “স্বয়ংক্রিয়” হতে গড়ে ৬৬ দিন লাগে—কেউ‑কেউ ১৮ দিনে, কেউ‑কেউ ২৫৪ দিনে। ধারাবাহিক চর্চাই মূল চাবিকাঠি।


৩. ভাল অভ্যাস গড়ার কৌশল

ক. বাধা ছোট করুন—টু‑মিনিট রুল

যে কাজ শুরুতেই বিশাল মনে হয়, সেটা মস্তিষ্ক “ঝুঁকি” হিসেবে দেখে এড়িয়ে চলে। তাই ইসলামি দৃষ্টিতে কোরআন তেলাওয়াতই হোক বা ইংরেজি অভিধান মুখস্থ—শুরু করুন মাত্র দুই মিনিট দিয়ে। নিয়মিত “শুরু”‑র সিগনাল পেলেই বেসাল গ্যাংলিয়া নতুন লুপ লিখে ফেলতে শুরু করবে।

খ. কিউ সাজান

পরিবেশই সবচেয়ে শক্তিশালী কিউ। রাতে রানিং‑শু বিছানার পাশে রাখুন, পানির বোতল ভরিয়ে দরজা‑ঘেষে রাখুন। সকালে চোখ খুলতেই এসব দৃশ্যই মস্তিষ্ককে কথা মনে করিয়ে দেবে।

গ. হ্যাবিট স্ট্যাকিং

কোনো বিদ্যমান অভ্যাসের সাথে নতুন কাজ “আঠার” মতো লাগিয়ে দিন: “চা চাপানোর পর ১ লাইন ভাব-জার্নাল লিখব”, “মাগরিবের পর পাঁচ মিনিট প্ল্যাংক করব” ইত্যাদি। পুরোনো কিউ‑টাকেই আপনার হয়ে কাজ করতে দিন।

ঘ. সৎ ডোপামিন

টিক‑মার্ক, ক্যালেন্ডারে ক্রস, মোবাইলে স্ট্রিক কাউন্টার—এসব ছোট পুরস্কারও মস্তিষ্ককে বলে, “দারুন! কাল আবার করো!” বন্ধুকে পাঠানো স্ক্রিনশট বা ফেসবুকে ৭‑দিনের গ্রাফ শেয়ার করাও শক্তিশালী।

ঙ. ‘ইফ‑দেন’ পরিকল্পনা

আগেই ঠিক করুন, বাধা এলে কী করবেন। “যদি দুপুরে একঘেয়েমি আসে, তবে অফিস‑করিডোরে ১০০ সেকেন্ড হাঁটব”, “যদি ইউটিউব খুলে ফেলি, তবে অন্তত এক ট্যাবে ‘ইংরেজি শেখা’ প্লেলিস্ট চালাব” ইত্যাদি। অস্থির মুহূর্তে পূর্বনির্ধারিত রুটিন আপনার পক্ষ নেবে।

চ. ট্র্যাক‑রিফ্লেক্ট‑অ্যাডজাস্ট

সপ্তাহে একদিন ১০ মিনিট সময় নিয়ে ফলাফল লিখে রাখুন—ওজন, আয়াত মুখস্থ, ব্যায়ামের রিপস, ঘুমের ঘণ্টা। পরিসংখ্যান দেখলে প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স বলে, “এখনও নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে” —ফলে অভ্যাস টিকে থাকে।


৪. খারাপ অভ্যাস ভাঙার কৌশল

ক. কিউকে অদৃশ্য করুন

রাত জেগে চিপস খাওয়া ‑ মুভি দেখা? চিপস রান্নাঘরের উপরের তাক বা তালা‑দেওয়া ড্রয়ারে রাখুন। ফোনে সোশ্যাল‑মিডিয়া ব্লকার ইনস্টল করুন,চোখের সামনে চকলেট না রেখে ফ্রিজের নিচের তাকে রাখুন। কিউ নেই তো রুটিন ট্রিগার হবে না।

খ. ঘর্ষণ বাড়ান

মোবাইল স্ক্রিন গ্রেস্কেল করলে রঙিন থাম্বনেইল‑এর আকর্ষণ কমে যায়। টিভি‑তে টাইম‑লক বা ওয়াই‑ফাই রাউটারে টাইমার সেট করুন—জরুরি না হলে খুলবেনই না। ২০ সেকেন্ড বাড়তি ঝামেলা অনেক বদ‑অভ্যাস আটকাতে পারে।

গ. রুটিন বদলে, রিওয়ার্ড রাখুন

বিকেলের আড্ডায় চিপস‑কোলা চাই? পরিবর্তে বাদাম‑খেজুর ও ফিজ্জি লেমন‑পানি দিন। নখ কামড়ানোর বদলে পকেটে ফিজেট‑কিউব রাখুন। পুরস্কারের অনুভূতি একই থাকলে মস্তিষ্ক দ্রুত নতুন রুটিন গ্রহণ করে।

ঘ. ‘আভিজাত্য তরঙ্গ’ সার্ফ করুন

ক্রেভিং অনেক সময় মাত্র ৯০ সেকেন্ড স্থায়ী হয়। চোখ বন্ধ করে শ্বাস‑প্রশ্বাস গুনুন, পানি খান, নামাজের ছোট সূরা পড়ুন। তরঙ্গ কাটলেই ইচ্ছেটা মিলিয়ে যাবে।

ঙ. পরিচয় পুনর্গঠন

“আমি ধূমপায়ী”, “আমি গেম‑অ্যাডিক্ট”—এই পরিচয় শক্তিশালী কিউ হিসেবে কাজ করে। ভাষা বদলান: “আমি ধূমপায়ী নই”, “আমি স্বাস্থ্য‑সচেতন”। নতুন পরিচয়ই নতুন রুটিনকে টিকিয়ে রাখে।

চ. জবাবদিহি

বন্ধু‑পরিবারের সামনে ঘোষণা করুন: “এক মাসের মধ্যে সিগারেট ছাড়ব—একটা খেলেও ৫০০ টাকা দান করব।” ক্ষতি‑ভীতি (loss aversion) মানুষের বড় মোটিভেটর।


৫. উন্নত ব্রেন‑হ্যাক

ক) টেম্পটেশন বান্ডলিং ২.০—আপনার প্রিয় সিরিয়াল বা ইউটিউব ভ্লগ কেবলমাত্র ট্রেডমিলে হাঁটার সময় দেখা যাবে।
খ) রিওয়ার্ড প্রেডিকশন এরর—কখনও‑সখনও নিজেকে অপ্রত্যাশিত ক্ষুদ্র পুরস্কার দিন; এতে ডোপামিন লুপ নতুন করে সক্রিয় হয়।
গ) মেন্টাল ভিজ্যুয়ালাইজেশন—রাতের বেলা চোখ বন্ধ করে পরের দিনের ব্যায়াম বা পড়াশোনার দৃশ্য কল্পনা করুন; এতে নিউরোনে মাইলিন কোটিং ঘন হয়, অভ্যাস আরও মসৃণ ভাবে চলে।
ঘ) “ফ্রেশ স্টার্ট” প্রভাব—নতুন বছর, জন্মদিন, বাংলা মাসের শুরু, এমনকি সোম‑বার; ক্যালেন্ডারের এই “রিসেট” মুহূর্তগুলোকে ব্যবহার করুন নতুন লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে।


৬. সাধারণ ভুল ও বাঁচার পথ

সব না হলে কিছুই না—এই মানসিকতা সবচেয়ে বড় ফাঁদ। একদিন বাদ পড়লে মনে হয়, “গেল তো সব!” কিন্তু বিজ্ঞান বলে, দীর্ঘমেয়াদে ৮০ % ধারাবাহিক হলেই ফল আসে। মোটিভেশন‑মিথ (“ইনস্পিরেশন এলে শুরু করব”) ভুলে যান; কাজ শুরু করুন, মোটিভেশন তখনই জেগে ওঠে। ল্যাপ্সকে রিল্যাপ্স হতে দেবেন না; সামান্য বিচ্যুতি মানে শুধু “পথে একটা স্পিড‑বাম্প”।


৭. উপসংহার ও আহ্বান

মস্তিষ্কের অটো‑পাইলট আসলে নিরপেক্ষ। আপনি চাইলে সেটাকে পুনর্গঠিত করে স্বপ্নপূরণের ট্রেন বানাতে পারেন, নাহলে তা হয়ে যাবে স্ব‑ধ্বংসের এক্সপ্রেস। আজ রাতেই ক্যালেন্ডারে একটা ক্ষুদ্র‑ভাল অভ্যাস লিখে রাখুন—হয়তো ২ মিনিট তেলাওয়াত, ১০ স্কোয়াট, বা এক লাইন কৃতজ্ঞতা। একইসঙ্গে একটা ছোট ঘর্ষণ‑কৌশল সেট করুন—মোবাইল থেকে সোশ্যাল‑মিডিয়া আইকন ডিলিট বা রাত ১১টার পরে রাউটার অফ। কাল সকালে যখন অ্যালার্ম বাজবে, মস্তিষ্ক তখনই নতুন সার্কিটের প্রথম সিগনাল পেয়ে যাবে—আর “স্নুজ”‑এর বদলে আপনাকে সূর্যোদয়ের পথে ঠেলবে। সামান্য ফাঁকি, বিশাল বিজয়!


সাইড‑বার

মিথ‑বাস্টিং: ইচ্ছাশক্তি কোনো সীমিত “ট্যাংক” নয়; সঠিক কিউ, পর্যাপ্ত ঘুম‑খাদ্য, ও অর্থপূর্ণ লক্ষ্য সেটআপ করলে তা পূনর্সঞ্চার হয়।
ডেটা‑ফ্যাক্ট: গড়ে ৬৬ দিনে নিয়মিত চর্চা অভ্যাসকে অটোমেটিক করে—ধৈর্যই মূল।

১৯ এপ্রিল ২০২৫


Discover more from LK INNOVATE

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment

Trending

Discover more from LK INNOVATE

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading