ড. লোকমান খান
ছোট গল্প

অনেক দিন পরেও আমি সেই দৃশ্য ভুলতে পারিনি। সন্ধ্যা নেমে আসছিল ধীরে ধীরে। শহরের গলিঘুঁজির ভেতরে একটা অদ্ভুত গুমোট আবহাওয়া—আকাশে মেঘ, বাতাসে আসন্ন ঝড়ের গন্ধ। ঠিক সেই সময় আমি একটা পুরনো বাড়ির পাশে একটা আলো-আঁধারির ছোট রাস্তায় দাঁড়িয়ে। একটা দৃশ্য চোখে পড়ল—ভাবতেও পারিনি এমন কিছু আমার সামনেই ঘটবে। বা ঘটতে পারে।

অনেক দিনের বন্ধু মিন্টু আমার সাথেই ছিল সেদিন। ভীরু স্বভাবের, সবসময় মানুষকে এড়িয়ে চলে। হঠাৎ আমরা দেখতে পেলাম, একটা কালো দামী গাড়ি থামলো রাস্তায়। গাড়ি থেকে নেমে এলেন একজন মানুষ, চেনা—টেলিভিশনের খবরে প্রায় প্রতিদিন দেখা এক রাজনীতিবিদ। ঢাকা শহরের প্রভাবশালী এক রাজনীতিক।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা গুলির শব্দ হল। শক্ত ধাতব আওয়াজে পুরো গলি কেঁপে উঠল। একটা মানুষ ধপ করে মাটিতে পড়ে গেল, লাল রক্তে ভিজে উঠল রাস্তা। আর সেই রাজনীতিবিদ, নির্বিকার ভঙ্গিতে আবার গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

আমি আর মিন্টু বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, কি ঘটে গেল। মুখে হাত চাপা দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “ও খোদা!” আমার গলা শুকিয়ে আসছিল। হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন দৃশ্য শুধু গল্প-উপন্যাসে পড়েছি এতোকাল, সিনেমায় দেখেছি—কখনো সামনে দেখিনি। একটা না বলা আতঙ্ক আমাকে পেয়ে বসল। শরীরে ঝিমঝিমে অনুভূতি, মনে হলো পা পিছলে পড়ে যাব যে কোনো মুহূর্তে।

পরদিন সেই ঘটনার খবর কিছুটা ঘুরে ফিরে মানুষের মুখে শুনলাম, তবে কেউ খোলাখুলি বলার সাহস পাচ্ছিল না—কারণ অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী নেতা।

তারপর কেটে গেল অনেকগুলো দিন। আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলাম। কিন্তু মাঝে মাঝেই রাতে ঘুমের মধ্যে ভয়াবহ স্বপ্ন দেখতাম। কোনো শব্দ শুনলে চমকে উঠতাম। এমন ক্ষমতার কুৎসিত প্রদর্শনী দেখে হাড় পর্যন্ত শিউরে উঠত।

অনেক দিন পরে হঠাৎ পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখলাম, সেই খুনের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। খবরের শিরোনামে বড় বড় করে নাম ছাপা হয়েছে ওই নেতার। তার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ। কিন্তু তিনি বলেছেন, “আমি কোনো খুন করিনি। আমাকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলা হয়েছে।” আমার বুক কেঁপে উঠল। কারণ আমি তো নিজেই দেখেছি সেই দৃশ্য। আমি তো জানি সে মানুষটাকে যে গুলি করেছিল। অথচ আদালতে তার জবানবন্দি শুনে মনে হলো, যেন সবকিছু একটা মিথ্যে রূপকথার গল্প!

ওই ঘটনাকে ঘিরে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতে আলোচনা হচ্ছে। অনেকে বলছে, “যিনি ক্ষমতায় থাকেন, তাকে তো এভাবেই ফাঁসানো হয়,” আবার কেউ বলছে, “ক্ষমতার দাপট আছে বলেই সে পার পেয়ে যাচ্ছে।”

বন্ধু মিন্টুর সাথে একটা কফিশপে দেখা হল। মিন্টু কফিতে চুমুক দিয়ে শান্ত গলায় বলল, “হুমায়ূন ভাই, তুমি কি আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেবে?”

আমি আমতা আমতা করে জবাব দিলাম, “কি বলছ? ওর ক্ষমতা তো তুমি জানো।”

মিন্টু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “একটা মানুষ খুন হলো, সে খুনের বিচার হবে না?” তার কথায় কোনো উত্তর দিতে পারলাম না।

ভীষণ শূন্যতা অনুভব করছি। একদিকে ক্ষোভ, অন্যদিকে অসহায়তা। আমরা যে সমাজে বাস করি, সেখানে অন্যায় দেখেও কোনো পদক্ষেপ নিতে অনেকেই ভয় পায়। ক্ষমতার মোহ আর রাজনৈতিক বিরোধের জাল এতো পেঁচিয়ে থাকে যে সত্য আর মিথ্যার মাঝখানে একটা ঘন কুয়াশা থাকে। আর সে কুয়াশায় আটকে যায় বিচার, আটকে যায় ন্যায়। সত্য প্রকাশের জন্য অপরিসীম সাহস দরকার।


সব কিছু বদলে গেছে।

আজকের সকালটা অন্য সকালগুলোর মতোই শুরু হলো। রোদটা বেশ মিষ্টি করে বারান্দায় এসে পড়ছিল। শান্ত অনুভূতি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিলাম। খুব বেশিক্ষণ সেই স্বস্তিটুকু আমার থাকল না। দরজায় একটা মৃদু শব্দ—কেউ যেন খুব দ্রুত একটা খাম গুঁজে দিয়ে চলে গেল। আমি দরজা খুলতেই দেখলাম, হলুদ রঙের একটা মোটা খাম।

খামটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে ঘরে ঢুকলাম। তার ওপর বড় বড় করে লেখা আছে, “জরুরি”। ভেতরে একটা চিঠি আর একটা সাদা-কালো ছবি। ছবি দেখেই বুকটা কেঁপে উঠল। অর্ধেকটা গলি অন্ধকারে ঢাকা, দূরে ধোঁয়াশা মতো লাইটপোস্টের আলো। একটা কালো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির পাশেই পিস্তল হাতে এক ব্যক্তি—ইচ্ছে করে অস্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে তার চেহারা। নিচে রক্তের দাগে ভেজা একটা মৃতদেহ পড়ে আছে। আর ছবির বাঁ দিকের কোণায় ভালো করে তাকিয়ে দেখি, কিছুটা দুর থেকে দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে পিস্তলধারীর দিকে। একজনের মুখের বেশির ভাগ অংশই আলো-আঁধারিতে ঢাকা, কিন্তু তার গাল দেখেই বুঝতে পারলাম ওটা আমার নিজেরই গাল!

এই দৃশ্য তো সেই রাতে দেখেছিলাম আমি, মিন্টুর সাথে! এতদিনে নারকীয় সেই হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি অনেকটা ধূসর হয়ে গিয়েছিল। এখন এ ছবি আবার সবকিছু নতুন করে মনে করিয়ে দিল। একটু পর চিঠিটা খুলে পড়লাম, যেখানে লেখা—“আগামী সপ্তাহে আদালতে হাজির হতে হবে। আপনাকে সাক্ষী দেওয়ার জন্য তলব করা হয়েছে।”

আদালতে আমাকে জিজ্ঞেস করা হবে—“ছবিতে বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি আপনিই তো? আপনি কি দেখেছেন যে এই মানুষটা গুলি করেছে?”

শিরদাঁড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। আমার কি করা উচিত? আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দেব, না কি চুপ করে থাকব?

এমন সময় দরজায় একটা টোকা পড়ল। একটা অপরিচিত মুখ, মধ্যবয়সী, চোখে কালো চশমা। আমার দিকে তাকিয়ে আঙুল দিয়ে ঈশারা করল। “আপনাকে কিছু বলার আছে।”

লোকটা নিচু গলায় বলল, “ছবিটা আপনি পেয়েছেন, তাই না? আদালতে গেলে খেয়াল রাখবেন, সব কথা বলে দেওয়ার পরিণতি ভালো নাও হতে পারে।” আর কিছু না বলে চলে গেল।

আমার সামনে দুটি পথ: একদিকে ন্যায়, অন্যদিকে বিপদ।

মিন্টুকে ফোন করলাম। প্রথমে কোনো সাড়া নেই। তৃতীয়বারে গিয়ে অবশেষে ফোনটা ধরল। আমি পুরো ঘটনা খুলে বলতেই, মিন্টু হুড়মুড় করে বলতে শুরু করল,
“দেখ, আজ হয়তো ও ক্ষমতায় নেই। কিন্তু তুমি দেখছ না—ওর দলের নেতা প্রতিদিন কেমন কেমন হুমকি দিচ্ছে! সবাইকে দেখে নেবে। না বাবা, আমি এর মধ্যে নেই। তুমি যা ইচ্ছা করো, কিন্তু আমাকে এই ঝামেলায় টানিও না।”

আমি এখন জানি আমি কি করব। এনাফ ইজ এনাফ।

১৬ এপ্রিল ২০২৫


Discover more from LK INNOVATE

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment

Trending

Discover more from LK INNOVATE

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading