(বাংলাদেশের বাস্তবতায় একটি ব্যঙ্গাত্মক রম্য-রচনা)

ড. লোকমান খান

  1. পরিচয়পর্ব
  2. গুজবের ঘোড়া বনাম ফেসবুকের সুপারসনিক
  3. পুরনো মশলা, নতুন ফন্দি
  4. রাজনীতির দরবারে আমার বিকিকিনি
  5. চায়ের দোকানের স্নায়ুযুদ্ধ
  6. সামাজিক যোগাযোগের ‘মহা’ যোগাযোগ
  7. রাজনৈতিক সমাবেশে গুজবের ‘হ্যান্ডসেক’
  8. সামলে চলুন: সতর্কীকরণ
  9. উপসংহার: ‘আমি গুজব, আমায় যত্ন করে দূরে রাখুন!’

পরিচয়পর্ব

শুভেচ্ছা, ভায়েরা! আমার নাম গুজব। শেক্‌সপিয়ারের ‘হেনরি দ্য ফোর্থ’ নাটকে আমাকে আপনি হয়তো দেখেছেন, কিন্তু বাংলাদেশের রাস্তায় আমি বহুল পরিচিত—শুধু নামটায় সামান্য হেরফের। আমার বাহন কিন্তু ঘোড়া নয়, বরং হালফ্যাশনের ফেসবুক, ইউটিউব, আর হোয়াটসঅ্যাপ! আমাকে একবার ধরতে গেলে দেখবেন, আমি আরেক জায়গায় গিয়ে হাজির। কেউ কেউ বলে, আমি নাকি হাওয়ার সাথে যাই; আসলে আমি হাওয়ায় ভেসে ফিরি না, বরং সবাইকে হাওয়া খাইয়ে দিই!

পুব দিকের কোনো পাড়া থেকে শুনবেন, “ভাই, আজ রাতেই বড় কিছু ঘটতে চলেছে!” “ড. ইউনূস আজকের ভাষনে পদত্যাগের ঘোষণা দেবেন!” আমি তখন হাওয়ার গতিতে পূর্বাঞ্চলের চায়ের দোকান পার হয়ে কেন্দ্রে ঢুকি; ঢাকায় পা রেখে দেখি, আরেক দল উত্তেজিত হয়ে বলছে, “অমুক পার্টির সভায় নাকি বোমা ফেটেছে!” ঠিক ওই সময়ে দক্ষিণের শহরে ছড়িয়ে পড়েছে, “নাহ, ওটা ফেক নিউজ!” আমি তাই শুনে হো হো করে হাসি; সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে কারই বা সময় আছে! আমি তো শুধু খবর ছড়াই, কে বিশ্বাস করল বা করল না, সেটায় আমার কিছুই যায়-আসে না।

গুজবের ঘোড়া বনাম ফেসবুকের সুপারসনিক

আগে শোনা যেত, গুজব নাকি ‘হাওয়ার ঘোড়ায় চড়ে’ ছুটে বেড়ায়। আজকাল সে ঘোড়াটা আপগ্রেড হয়ে গেছে ফেসবুক বা ইউটিউবের আলোর গতির মতো কিছুতে। ইন্টারনেটের কল্যাণে আমি এক কোণায় ‘গুজবে’র বীজ বুনে দিলে, চোখের পলকেই সেটা পুরো শহরে, দেশময় ছড়িয়ে পড়ে। ইউরোপ আমেরিকায় যেতেও সময় লাগে না। তার ওপর আছে নানা ফেসবুক গ্রুপ, যেখানে “বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেল…” জাতীয় কথায় সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কেউ মূল সূত্র খোঁজে না, বরং প্রতিটি মন্তব্যে এমন সব তথ্য যোগ হয় যে আমার মনে হয়, “বাহ! আমি নিজেও এত কিছু জানতাম না!”

আসল খবর কি, কবে কোথায় কী ঘটেছে—সেগুলো কেবল লাইব্রেরির ধূসর কোণে পড়ে থাকুক। মানুষ এখন অনেক বেশি উন্মুখ আমার নতুন-নতুন গল্পের দিকে। আমি একবার বলে ফেললাম, “ঢাকার রাজপথে নাকি ফাঁকা হয়ে গেছে, জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে,” ব্যস, অমনি সবাই লাইক, শেয়ার, কমেন্টের ঝড় তোলে।

পুরনো মশলা, নতুন ফন্দি

শুনতে মজার লাগলেও, আমার কাজটা কিন্তু বেশ সৃজনশীল। একই পুরনো গল্প ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে মানুষকে খাওয়াতে হয়। যেমন, দেশের যেকোনো বড় ঘটনার পর আমি ফিসফিস করে একটা তথ্য ছড়িয়ে দিই, “শুনেছেন তো? এর পেছনে হাত আছে অমুকের!” — তারপর কয়েকজন দুম করে বলে ওঠে, “আরে, আমি আগেই জানতাম!” এভাবেই আমার পুরনো মশলায় নতুন স্বাদ আসে।

তবে আমার কাছে সব চেয়ে আনন্দের ব্যাপার হলো, মানুষ আগেপিছে না ভেবেই আমার খবরকে প্রতিষ্ঠিত সত্য ধরে নেয়। প্লেন ক্র্যাশ হোক, বিদ্যুত্‌ বিপর্যয় হোক, কিংবা কোনো নেতা-নেত্রী ‘হঠাৎ অসুস্থ’—আমি মুহূর্তেই “দেখুন, অমুক ফেসবুক পেজে কী বলে!” বলে গুজবটা ছড়িয়ে দিই। যারা বিশ্বাস করে, তারা ঠিকই আমার পেছনে হাঁটে। আর যারা বিশ্বাস করে না, তারা আবার মন্তব্যে এসে মুখরোচক লড়াই করে। ফসল? আমার জনপ্রিয়তা বাড়ে কেবল।

রাজনীতির দরবারে আমার বিকিকিনি

রাজনৈতিক ময়দানে আমার কদর যে কত, তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। নির্বাচনের আগে হোক, পরে হোক, একটা হালকা গুজব ছুড়ে দিলেই হবে। দেশের সব টক শো, পাড়া-মহল্লার চায়ের আড্ডা, বাস-ট্রেনের দাঁড়ানো যাত্রী—সবাই সেই গুজব নিয়ে তর্কে মেতে ওঠে।

উদাহরণস্বরূপ, ধরুন, হঠাৎ একজন বললেন, “নতুন কোনো ঐক্য গঠিত হচ্ছে, যেখানে সব দল এক হলো!” আরেকজন পাল্টা বললেন, “আরে না, ওটা গুজব। আসলে ভেতরে ভেতরে আবার দ্বন্দ্ব!” ব্যস, আমার মোটেও কষ্ট করতে হলো না; শুনে শুনেই মানুষ পরবর্তী ঘণ্টা-দুই এই গুজব নিয়ে কাটিয়ে দিল। এই ফাঁকে আমি ফুরফুরে মেজাজে অন্য কোথাও ছড়িয়ে এলাম আরেকটা খবর।

চায়ের দোকানের স্নায়ুযুদ্ধ

চায়ের দোকানগুলো হলো আমার প্রিয় অলিন্দ। এখানে সারাদিন খবরের চর্বিতচর্বন চলে। “ইলিশের দাম বাড়লে গুজবের দোষ, কমলে গুজবের দোষ!”—মানুষ যদিও রসিকতা করে এমন বলে, আসলে ভাবুন: ইলিশের দাম বাড়ার পেছনে নাকি ‘অমুক চক্র’ কাজ করেছে, এমন একটা গুজব ছড়িয়ে দিলেই লোকজনের মাতামাতির শেষ থাকে না।

পাশের জন বলে, “ধরুন, গতকাল রাতে নাকি আরেকটা দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা হয়েছে!”—আর পাঁচজন উৎসুক হয়ে শোনে, “আরে! সে কী! কোথায় শুনলেন?” এগুলো জেনে লাভ কী, কে জানে! তবুও গুজবের সেই বৈঠকে সবাই হা করে শোনে।

সামাজিক যোগাযোগের ‘মহা’ যোগাযোগ

আগে গুজব ছড়াতে সময় লাগত। কাউকে মুখে মুখে বলতে হতো; তারপর লোকেরা অন্যজনকে বলে ছড়াত। এখন আমি ফেসবুক লাইভে এসে বা ইউটিউবে একটা ভিডিও ছাড়লেই কয়েক ঘণ্টায় লাখখানেক ভিউ আর শেয়ার হয়। বেনামি কিছু পেজ এক মিনিটের মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত সংবাদ বা কথিত তথ্য ছেড়ে দেয়, আর লোকে দেখে বিশ্বাস করে।

অনেক সময় লোকে আমাকে ট্যাগ করে রেফারেন্স দেখায়—“দেখুন, ওখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে, ‘বিশ্বস্ত সূত্রে খবর।’” আমার কী আনন্দ! আমি তখন নিজেই হেসে বলি, “ওই ‘বিশ্বস্ত সূত্র’ হলো আসলে আমার অন্য সত্তা, যে নিজেই খোঁড়া উপসংহার বানিয়ে ছড়িয়েছে!” সত্যি-মিথ্যা যাচাই করা তো সেকেলে ব্যাপার!

রাজনৈতিক সমাবেশে গুজবের ‘হ্যান্ডসেক’

রাজনৈতিক সমাবেশ বা মিছিলে আমাকে পেলে সবাই খুশি থাকে। কারণ কী? একটার পর একটা স্লোগানে তো আর আগ্রহী জনতা খুশি হয় না; তাতে একটু মশলা দরকার। তাই হঠাৎ কেউ ফিসফিস করে বলে, “শুনছেন, ওপাড়ার মিটিংয়ে জনসমাগম নেই, ছবি ফেক!”—আর সাথে সাথে আরেকদল বলে, “হ্যাঁ, তা নাকি!” অতএব, মিছিলের উত্তেজনা বাড়ে।

এইভাবে ছোট্ট একটা কথা দিয়েই কত মানুষকে প্রভাবিত করা যায়! মিডিয়াতেও পরে ছোট্ট একটা স্ক্রল চালিয়ে দেয়, “অনেকে বলছেন…”—অর্থাৎ, কারা বলছে বা কী বলছে, সেটার সত্য-মিথ্যা যাচাই আর করা হয় না। আমি চোখ বন্ধ করে মুচকি হাসি—ব্যস, কাজ তো শেষ!

সামলে চলুন: সতর্কীকরণ

এবার মূল বিষয়ে আসি। স্বীকার করি, আমার উপস্থিতি সবার মনে আগ্রহ জাগায়, আলোচনা বাড়াই, এমনকি কিছু গসিপ-রসিকের জীবনে উৎসবের সুবাস আনে। কিন্তু এই গুজবের যুগে লোকে কখনো কখনো কষ্টও পায়, ভুল বুঝে বড় ধরনের অঘটন ঘটায়। কেউ কেউ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আমার খবর ছড়িয়ে দেয়, তারপর দেখা যায়—পুরোটাই ভুল। রাজনৈতিক অপপ্রচার থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত চরিত্র হনন—সবকিছুতেই আমার অবদান কম নয়।

তাই সাবধান ভাইসব! আমি যেখানেই থাকি, সেখানেই কৌতূহল আর সন্দেহের ডিম পাড়তে থাকি। কিন্তু আপনাদের তো হেঁটে চলার পথে সত্যতা যাচাইয়ের একটা দায় আছে, তাই না? হাতে আপনার স্মার্টফোন আছে, ইন্টারনেট আছে—কিছু খোঁজ নিয়ে, নির্ভরযোগ্য সূত্র দেখে নিয়ে, একটু যাচাই করে দেখলেই পারেন, কোনটা সত্য আর কোনটা আমার বানানো ফানুস।

উপসংহার: ‘আমি গুজব, আমায় যত্ন করে দূরে রাখুন!’

এই হলো আমার সাক্ষাৎকারের শেষ পর্ব। আমাকে পাত্তা না দিলেও চলে, কিন্তু আমার ঠেলায় অনেক কিছুই ওলট-পালট হয়। কখনো উসকানি, কখনো হানাহানি, কখনো বা সম্প্রীতি নষ্ট করা—আমি সব সময় আছি ক্ষমতার দৌড়ে, মানুষের ফিসফাসে।

আসুন, একটু সচেতন হই। যে কোনো খবর পাওয়ার পর ভেবে দেখি, এর সূত্র কী? সত্যতা কীভাবে যাচাই করব? তড়িঘড়ি শেয়ার কিংবা মন্তব্য করে লোকজনকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলা কি আদৌ ঠিক?

পরিশেষে, আবার বলে রাখি—আমি গুজব; আমার গল্প খুব মশলাদার, তাতে সংবেদনশীলতার অভাব নেই। আমাকে আপনি পছন্দ করতেই পারেন, কারণ সবার মধ্যেই একটা উৎসুক মন আছে। কিন্তু এটা মনে রাখবেন, আমার বেশিরভাগ গল্পই আসলে ‘গায়েই মানে না, আপনি মোড়ল!’—রসের ঝোল ভরা, কিন্তু সত্যতাবিহীন।

সুতরাং ‘সতর্ক’ থাকুন, আর যদি কোনোদিন আমার মুখোমুখি হন—দয়া করে যাচাই করবেন। টক-ঝাল-মিষ্টি গুজব চেখে দেখতে মন্দ নয়, তবে সেটা গিলতে গেলে পেটের ব্যথা যে বাধাবেই! আর যদি কখনো আমার ওপর রাগ হয়, তাহলে বলবেন—“বাপু, একটু গেস্টো অ্যাসিডের ওষুধ খেয়ে নাও, আমাদের আজ আর তোমার নাটক দেখার সময় নেই!”

কাজেই, ভাইসব, সতর্ক থাকুন! আমি গুজব—আপনাদের মাঝে বিভ্রান্তির জ্বালানি। ফেসবুক হোক বা বাস্তবের গলি গুপচি হোক, যেখানে খুশি খেলে বেড়াই। আপনি যদি একটুখানি যাচাই করেন, তাহলে আমায় সহজেই হার মানতে হবে।

২৫ মার্চ ২০২৫


Discover more from LK INNOVATE

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment

Trending

Discover more from LK INNOVATE

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading