ড. লোকমান খান

১. ভূমিকা

১.১ এআইয়ের বৈশ্বিক উত্থান

বর্তমান সময়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (Artificial Intelligence) আমাদের জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে জোরালোভাবে প্রভাব ফেলছে। বিশ্বজুড়ে শিল্প, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও আর্থিক খাত—সবখানেই এআই-এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। PwC-এর গবেষণা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে এআই প্রায় ১৫.৭ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ অতিরিক্ত মূল্য বিশ্ব অর্থনীতিতে যোগ করতে পারে। এর মাধ্যমে শুধু বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোই নয়, বরং ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের উদ্যোগ, স্টার্টআপ, এমনকি সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিভিন্ন সংস্থাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উপকৃত হচ্ছে। তাই আজকের ডিজিটাল বিশ্বে এআই সম্পর্কে আগেভাগেই সচেতন হওয়া, এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা, এবং সর্বোপরি নিজস্ব সক্ষমতা বিকাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি যদি একজন নীতিনির্ধারক, উদ্যোক্তা বা শিক্ষার্থী হয়ে থাকেন, তাহলে আপনার জানা দরকার যে এআই কেবল ভবিষ্যত প্রযুক্তি নয়, এটি এখনই আমাদের চারপাশের বাস্তবতা বদলে দিচ্ছে। এ কারণেই সময় এসেছে কেবল প্রযুক্তি আমদানি না করে, বাংলাদেশের নিজস্ব এআই সমাধান তৈরিতে উদ্যোগী হওয়ার।

১.২ বাংলাদেশের সন্ধিক্ষণ

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। বহিরাগত প্রযুক্তি আমদানি করে সুবিধা নেওয়া একদিকে সহজ মনে হতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে অভ্যন্তরীণ উদ্ভাবন ও গবেষণার অভাবে দেশীয় সক্ষমতা গড়ে ওঠা ব্যাহত হয়। ফলত প্রযুক্তিগত নির্ভরশীলতা বেড়ে যায়, যা অর্থনৈতিকভাবে দেশের স্বনির্ভরতা কমিয়ে দিতে পারে।

সুতরাং, প্রশ্নটি দাড়ায়—আমরা কি কেবল অন্য দেশের এআই পণ্য ও সেবা ব্যবহার করেই সীমাবদ্ধ থাকব, নাকি নিজস্ব জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে তৈরি করব টেকসই সমাধান? এই নিবন্ধের মূল বক্তব্য হলো: বাংলাদেশকে কেবল প্রযুক্তির ‘গ্রাহক’ না হয়ে, এআই-এর একজন ‘উৎপাদক’ (Maker) হওয়ার পথে অগ্রসর হতে হবে।

বাংলাদেশের এআই সম্ভাবনা

২.১ জনমিতিক সুবিধা

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ তরুণ, যারা আগ্রহী ও দক্ষ হয়ে উঠছে প্রযুক্তি ব্যবহারে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এই যুবসমাজের মধ্যেই রয়েছে উদ্ভাবনী চিন্তাশক্তি এবং নতুন কিছু শেখার আগ্রহ। সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি তরুণ প্রজন্মকে প্রযুক্তিতে উৎসাহিত করতে ইতোমধ্যে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।

যথাযথ প্রশিক্ষণ, নীতিগত সহায়তা ও গবেষণামূলক প্রকল্পের সুযোগ পেলে তরুণ জনগোষ্ঠী সহজেই এআই খাতে শক্তিশালী অবদান রাখতে পারে। দেশে যদি একদিকে গবেষণা ও উন্নয়নের (R&D) পর্যাপ্ত সুযোগ তৈরি হয় এবং অন্যদিকে শিল্প-অ্যাকাডেমিয়া সহযোাগিতা দৃঢ় হয়, তাহলে বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে এআই ভিত্তিক নতুন নতুন উদ্যোগের জন্ম নেওয়া সম্ভব।

২.২ দ্রুত ডিজিটাল সংযোগ

বাংলাদেশে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিটিআরসি-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার বড় একটি অংশ এখন মোবাইল ইন্টারনেট অ্যাক্সেস করতে পারে। এর ফলে আর্থিক খাত থেকে শুরু করে ই-কমার্স, টেলিমেডিসিন, এবং শিক্ষা খাতে ডিজিটাল সেবার সম্প্রসারণ ঘটছে। এসব ক্ষেত্রেই এআইভিত্তিক প্রযুক্তি যোগ হলে সেবার গুণগত মান ও ব্যাপ্তি আরো বাড়ানো যায়।

যেমন, ফিনটেক সেক্টরে এআই ব্যবহার করে গ্রাহকের লেনদেন বিশ্লেষণ করা বা দ্রুত ঋণ মঞ্জুরির ব্যবস্থা করা সম্ভব হচ্ছে। অন্যদিকে, গ্রামাঞ্চলে টেলিমেডিসিন সেবা দিতে এআই-চালিত ডায়গনস্টিক টুল রোগ নির্ণয়ের প্রাথমিক পর্যায়কে অনেক সহজ করে তুলতে পারে। এই দ্রুত সংযুক্তির যুগে, এআই সল্যুশনগুলো যদি স্থানীয় পর্যায়ে তৈরি হয়, তবে সেগুলো আরো কার্যকর, সাশ্রয়ী ও সংস্কৃতিসহযোগী হয়ে উঠবে।

২.৩ বিদ্যমান সাফল্যের উদাহরণ

দেশীয় কিছু স্টার্টআপ ইতোমধ্যে এআই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় ভাষা শনাক্তকরণ বা বাংলা লিপিতে পাঠ প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান এআই সল্যুশন তৈরি করেছে। আবার কোনো কোনো উদ্যোক্তা কৃষি খাতে এআইভিত্তিক পূর্বাভাস ও বিশ্লেষণী প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করছে, যা কৃষকদের নির্দিষ্ট ফসলের সম্ভাব্য ফলন বা রোগবালাই সম্পর্কে সচেতন করে।

এসব উদ্যোগ প্রমাণ করে যে যথাযথ সহায়তা, পৃষ্ঠপোষকতা এবং কৌশলগত বিনিয়োগ থাকলে বাংলাদেশে উদ্ভাবনী এআই প্রকল্প তৈরি হওয়া সম্ভব। শুধু অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ নয়, সুশিক্ষিত শিক্ষার্থী, পেশাজীবী এবং উদ্যোক্তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের এআই খাতকে এগিয়ে নেওয়া যায়।

৩. স্থানীয় উদ্ভাবনকে জোরদার করা

৩.১ দেশীয় এআই উন্নয়নের মূল্য

যেকোনো প্রযুক্তিকে যখন স্থানীয় পরিবেশে তৈরি ও অভিযোজন করা হয়, তখন সেটি বাস্তব চাহিদার সঙ্গে অনেক বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। বাংলাদেশের মতো জনবহুল ও বৈচিত্র্যময় দেশে, ভাষা, সংস্কৃতি, ও অর্থনৈতিক কাঠামোর বিষয়গুলো বিবেচনা করে এআই তৈরি করা হলে ব্যবহারকারীর সুবিধা ও আস্থা দুটোই বাড়ে।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলা ভাষার জন্য আলাদা করে ভয়েস রিকগনিশন সিস্টেম বানালে গ্রামাঞ্চলের মানুষও ডিজিটাল সেবা সহজে নিতে পারবে। তাছাড়া, স্থানীয়ভাবে তৈরি সেবা ও পণ্য রপ্তানির সুযোগ থাকায় দেশের অর্থনীতি বহুমাত্রিকভাবে লাভবান হতে পারে।

৩.২ গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্কৃতি গড়ে তোলা

দেশে এআই গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও শিল্পখাতের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানো জরুরি। যথেষ্ট তহবিল, ল্যাব, ও প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নিশ্চিত না করতে পারলে উদ্যোক্তারা কিংবা শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের উদ্ভাবনী কাজ করতে পারে না। এজন্য সরকারি এবং বেসরকারি খাতে যৌথভাবে উচ্চতর গবেষণা তহবিল গঠন, ইনকিউবেটর প্রোগ্রাম চালু, এবং আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্স আয়োজন খুবই দরকার।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে এআই বিষয়ক কোর্স অন্তর্ভুক্ত করা এবং সেগুলোকে ব্যবহারিক গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা। এতে শিক্ষার্থীরা বাস্তব প্রকল্পে কাজের সুযোগ পাবে, যা পরবর্তীতে তাদের চাকরিক্ষেত্র বা উদ্ভাবনে সহায়ক হবে।

৩.৩ মানবসম্পদ ও দক্ষতা উন্নয়ন

মানবসম্পদ উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করলেই হবে না, এআই-এর নির্দিষ্ট দক্ষতা ও ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে পুনঃপ্রশিক্ষণ (re-skilling) এবং উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ (up-skilling) চালু রাখলে পেশাজীবীরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এআই-এর নতুন দিকগুলো আয়ত্ত করতে পারবেন।

এখানে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যাংকগুলোতে এআই সমাধান বাস্তবায়নের আগে কর্মীদের মৌলিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা প্রযুক্তিকে ভয় না পেয়ে এর সুবিধা সম্পর্কে অবহিত হয় এবং ব্যবহার করতে শেখে।

৪. চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ

৪.১ অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা

এআই গবেষণা ও উন্নয়নে উচ্চগতির ইন্টারনেট, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, এবং সার্ভার/ডেটা সেন্টার ব্যয়-সাশ্রয়ীভাবে ব্যবহারের সুযোগ থাকা আবশ্যক। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো অনেকখানি পিছিয়ে। বড় ডেটাসেট নিয়ে কাজ করতে গেলে প্রচুর কম্পিউটিং শক্তি দরকার, যা অনেক সময় ব্যয়বহুল বা স্থিতিশীল নয়।

এই সমস্যা সমাধানে সরকার ও বেসরকারি খাতে অংশীদারিত্বমূলক বিনিয়োগ দরকার। উদাহরণস্বরূপ, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (PPP) মাধ্যমে ডেটা সেন্টার বা সার্ভারের অবকাঠামো গড়ে তোলা যেতে পারে। তাছাড়া, দেশে যদি ক্লাউড কম্পিউটিং সুবিধা স্বল্পমূল্যে পাওয়া যায়, তবে ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোও বড় প্রকল্পে কাজ করার সাহস পাবে।

৪.২ মেধাপাচার ও মেধা ধরে রাখা

বাংলাদেশ থেকে মেধাবী শিক্ষার্থী ও বিশেষজ্ঞরা বিদেশে উচ্চশিক্ষা কিংবা উন্নত সুযোগের আশায় পাড়ি জমাচ্ছেন। এআই-ভিত্তিক গবেষণা ও কাজের ক্ষেত্র দেশেই গড়ে তুলতে না পারলে এই মেধাপাচার দীর্ঘমেয়াদে দেশকে পিছিয়ে দেবে।

সমাধান হিসেবে সরকার ও শিল্পখাতে গবেষণা অনুদান, স্টার্টআপ অনুদান, আকর্ষণীয় বেতন কাঠামো ও ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ তৈরি করতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যৌথ গবেষণা ল্যাব গড়ে তুলে তরুণদের প্রতিভাকে দেশের ভেতরেই বিকশিত করার পথ খুঁজতে হবে।

৪.৩ তহবিল ও বিনিয়োগ সংকট

এআই-ভিত্তিক স্টার্টআপ বা প্রকল্পের জন্য বড় ধরনের মূলধন প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ এখনো পর্যাপ্ত ভাবে প্রযুক্তি খাতে উৎসাহী হয়ে ওঠেনি। ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড বা অ্যাঞ্জেল ইনভেস্টরদের সংখ্যা সীমিত।

এক্ষেত্রে সরকারের উচিত এআই ও প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগকে উৎসাহ দিতে কর ছাড়, বিশেষ তহবিল অথবা লোন সুবিধা চালু করা। একইসঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করতে সহজ শর্তে লগ্নির সুযোগ দিতে হবে। এর পাশাপাশি স্থানীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্টার্টআপে বিনিয়োগের ঝুঁকি নেওয়ার মতো উপযোগী নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

৪.৪ নৈতিক ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো

ডেটা গোপনীয়তা, অ্যালগরিদমিক পক্ষপাত (bias) এবং সামাজিক প্রভাব নিয়ে এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এআই-এর সুষ্ঠু ব্যবহার এবং ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত নীতি থাকা দরকার।

ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়া রোধ করা এবং এআই-এর সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা বজায় রাখার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এর জন্য সরকার, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার সংস্থা ও আইনপ্রণেতাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। নীতিমালার পাশাপাশি প্রয়োগের ব্যাপারেও সচেতন থাকা জরুরি।

সরকারের ও বেসরকারি খাতের ভূমিকা

৫.১ এআই-এর জন্য নীতিকাঠামো

একটি জাতীয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কৌশল প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবী। এই কৌশল বা রোডম্যাপের মাধ্যমে গবেষণা অনুদান, পাইলট প্রোজেক্ট, এবং সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা সহজ হবে।

উদাহরণস্বরূপ, শিক্ষা, কৃষি ও স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে এআই-এর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে। এর ফলে শুধু নগর এলাকাতেই নয়, বরং গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এআই সেবার সুষ্ঠু বিস্তার ঘটবে।

৫.২ সরকার ও বেসরকারি খাতের অংশীদারিত্ব

এআই খাতে টেকসই উদ্ভাবন নিশ্চিত করতে সরকার ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সমন্বয়মূলক প্রচেষ্টা অপরিহার্য। বড় প্রযুক্তি কোম্পানি বা টেলিকম অপারেটররা অবকাঠামো সরবরাহ ও বিনিয়োগ করতে পারে, আর সরকার প্রয়োজনীয় নীতিগত সহায়তা ও রেগুলেটরি সুবিধা দিতে পারে।

যেমন, ই-গভর্নেন্স বা ডিজিটাল সেবাগুলোয় এআই প্রযুক্তি একীভূত করা যেতে পারে। এতে সেবাগ্রহীতার সময় ও খরচ দুটোই বাঁচবে, পাশাপাশি সরকারি সেবার স্বচ্ছতাও বাড়বে। এভাবে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রযুক্তির প্রতি আস্থা এবং গ্রহণযোগ্যতা বেড়ে যাবে।

৫.৩ বৈশ্বিক এআই সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগ

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে বিশ্বের নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি জায়ান্ট ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে নিয়মিত জ্ঞান বিনিময় করা দরকার। আন্তর্জাতিক সম্মেলন, অনলাইন সেমিনার বা গবেষণা সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা কিংবা গবেষকরা বৈশ্বিক মানচিত্রে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে পারবে।

এছাড়া, যৌথ উদ্যোগে পণ্য বা সেবা তৈরির ফলে দেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ আসার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ দক্ষতাও সমৃদ্ধ হবে।

৬. অন্তর্ভুক্তিমূলক এআই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতকরণ

৬.১ শহর-গ্রাম বৈষম্য কমিয়ে আনা

শহর ও গ্রামাঞ্চলের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন এখনো স্পষ্ট। এই বৈষম্য দূর করতে এআইকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কৃষি ক্ষেত্রে এআইভিত্তিক পূর্বাভাস সিস্টেম চালু করে সেচ ও সার ব্যবস্থাপনাকে অধিক কার্যকর করা সম্ভব। আবার ড্রোন বা রোবোটিকস ব্যবহার করে দ্রুত ও সঠিকভাবে ফসল পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।

স্বাস্থ্য খাতে টেলিমেডিসিন এখন আলোচিত বিষয়। গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যের কেন্দ্রগুলোতে এআইভিত্তিক রিমোট চেকআপ সিস্টেম বা রোগ নির্ণয় ব্যবস্থাপনা চালু করলে অনেক মানুষের জীবন রক্ষা পেতে পারে। এটি শুধু প্রযুক্তি উন্নয়ন নয়, বরং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

৬.২ পশ্চাদপদ ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন

এআই খাতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নকশা করার সময় নারীদের অংশগ্রহণ, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উপযোগিতা বিবেচনা করা চাই। উদাহরণস্বরূপ, যে সকল নারীরা পরিবারিক বাধার কারণে বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারেন না, তারা ঘরে বসে অনলাইনে এআইভিত্তিক কাজ করতে পারেন—যেমন, ডেটা লেবেলিং, ভাষাগত অনুবাদ ইত্যাদি।

এভাবে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এআই উন্নয়ন ও ব্যবহারের আওতায় আনলে প্রযুক্তির সুযোগ বাড়ে, বৈষম্য কমে, এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত হয়।

৭. উপসংহার

৭.১ প্রধান যুক্তিগুলোর পুনরুল্লেখ

এআই শুধু একটি প্রযুক্তি নয়, এটি আজকের দিনে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতার অন্যতম চালিকাশক্তি। বাংলাদেশে জনমিতিক সুবিধা, দ্রুত ডিজিটালাইজেশন, এবং তরুণ প্রজন্মের উচ্চ উৎসাহ এসবই এআই উন্নয়নের পক্ষে কথা বলে। কিন্তু অবকাঠামো, প্রশিক্ষণ ও বিনিয়োগের অভাব, এবং মেধাপাচার আমাদের সামনে বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

আমরা যদি স্থানীয় উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে পারি, মানুষের দক্ষতা বাড়াতে পারি, এবং সরকার ও বেসরকারি খাতের সমন্বয় ঘটাতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ একজন এআই ‘তৈরি-ক্ষম’ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে।

৭.২ ভবিষ্যতের রূপরেখা

ভবিষ্যতে এআই হতে পারে বাংলাদেশের কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিল্প, ও সেবা খাতের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। সঠিক পরিকল্পনা ও সময়োচিত বিনিয়োগের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের কর্মসংস্থান বাড়বে, বৈদেশিক বিনিয়োগ আসবে, এবং আমাদের রপ্তানি খাতও বৈচিত্র্যময় হবে।

এই পথচলায় আমাদের প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট নৈতিক বিধি, ডেটা সুরক্ষা আইন, এবং নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে শক্তিশালী করতে হবে। যাতে প্রযুক্তি মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয় এবং সম্ভাব্য ঝুঁকিগুলো কমিয়ে আনা যায়।

৭.৩ কর্মপরিকল্পনার আহ্বান

এখনই সময় নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী নেতা, শিক্ষাবিদ ও সাধারণ জনগণকে একসঙ্গে কাজ করে এআই-এর সুযোগগুলোকে সর্বোচ্চ মাত্রায় ব্যবহার করার।

  • আপনি যদি নীতিনির্ধারক হন, তবে দেরি না করে একটি জাতীয় এআই নীতিমালা প্রণয়ন করুন।
  • আপনি যদি উদ্যোক্তা হন, তবে এআই-ভিত্তিক স্টার্টআপ ও সেবা তৈরির বিষয়ে ভাবুন।
  • আপনি যদি শিক্ষক বা গবেষক হন, তবে তরুণদের হাতে এআই-এর ব্যাকরণ ও ব্যবহারিক প্রয়োগ তুলে দিন।
  • আপনি যদি সাধারণ নাগরিক হন, তবে এআই সম্পর্কে জানুন, এগিয়ে যান, এবং দেশীয় প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে আমাদের উদ্ভাবনকে সমর্থন করুন।

সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই “The force of AI: Bangladesh should be a maker, not just a taker” স্লোগানটি বাস্তবে পরিণত হবে। এআই খাতে দেশীয় সৃষ্টি ও রপ্তানি গড়ে তুলতে পারলে আমরা প্রযুক্তিনির্ভর বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় শক্ত অবস্থান অর্জন করতে পারব। এই যাত্রায় শামিল হওয়া প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও গর্বের বিষয়। এখনই সময় সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার, যেন ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতিতে গর্বিত অংশীদার হয়ে উঠতে পারে।

২৭ জানুয়ারি ২০২৫


Discover more from LK INNOVATE

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment

Trending

Discover more from LK INNOVATE

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading