ডঃ লোকমান খান

অনেকেই “সহমর্মিতা” (empathy) এবং “সহানুভূতি” (sympathy) শব্দ দুটিকে একে অপরের সাথে গুলিয়ে ফেলেন। আসলে শব্দ দুটি বেশ আলাদা দুটি আবেগীয় চিত্র প্রকাশ করে। সহমর্মিতা হলো অন্য কারো জুতা পড়ে হাঁটার মতো। এটি অন্যদের আবেগ বোঝার এবং তাদের দৃষ্টিকোণ অনুভব করার বিষয়। তারা কী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পার হচ্ছে তা সত্যিকারে অনুভব এবং বোঝার বিষয়। তাদের আবেগের সাথে এমন ভাবে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা যেন তা নিজেব অভিজ্ঞতা বা সমস্যা। অন্যদিকে, সহানুভূতি দূর থেকে অন্য কারো অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার মতো। এটি কারো খারাপ অভিজ্ঞতার জন্য দুঃখ বা কষ্ট অনুভব করা এবং তা দুর থেকে। সহানুভূতি যদি হয় উদ্বেগের সাথে মাথা দোলানো, কিছু ভালো কথা বলা, সেখানে সহমর্মিতা হলো হাতে হাত রেখে অন্যের অভিজ্ঞতার স্পন্দন হৃদয়ে অনুভব করা। সহমর্মিতা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পূর্ণ বিশ্বে অনুভূতির বিভিন্নতার মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করে। মানুষের মধ্যে শক্তিশালী সংযোগ গড়ে তোলে। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্কের জন্যই নয়, বরং একটি সহানুভূতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্যও অত্যাবশ্যক নৈপুণ্য।

আধুনিক সমাজে আমরা কি সহমর্মিতা থেকে ক্রমেই দুরে সরে যাচ্ছি? আমরা কি ফেসবুক প্রেষিত ‘সহানুভূতি’র অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছি? অথচ আমরা চাইলেই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। তা হতে পারে ব্যক্তি জীবনে, সম্পর্কে, শিক্ষায়, রাজনীতিতে বা রাষ্ট্র পরিচালনায়।

সহমর্মিতার এক-মাত্রিক বিষয় নয়। এতে অন্তর্ভুক্ত জ্ঞানীয় সহমর্মিতা যেখানে আপনি বুদ্ধিগতভাবে কারোর দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করেন; আবেগীয় সহমর্মিতা যেখানে আপনি অন্য ব্যক্তি কী অনুভব করেন তা নিজে অনুভব করেন; এবং দয়াশীল সহমর্মিতা যা আপনাকে অন্যদের বিপদে হাত বাড়িয়ে দিতে উদ্ভুদ্ধ করে। এই উপাদানগুলির ভারসাম্য বজায় রাখাতেই একটি সম্পূর্ণ সহমর্মী মনোভাবের চাবিকাঠি।

সম্পর্কের মধ্যে সহমর্মিতা সম্পর্ককে আরও গভীর করে। সম্পর্ককে একটি বাগান হিসাবে কল্পনা করুন; সহমর্মিতা হল পানি যা বাগানের গাছ পালাকে তাজা রাখে। সহমর্মিতা পরিবারে শক্তিশালী বন্ধন তৈরি করে এবং বোঝারড়া বাড়ায়। বন্ধুত্ব এবং রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে এটি গভীরতা এবং বিশ্বাস গড়ে তোলে। পেশাদার ক্ষেত্রে, দলবদ্ধ কাজে সহমর্মিতা দ্বন্দ্ব নিরসন হজ করে তোলে। সহমর্মিতা আমাদের সমস্ত ধরণের সম্পর্কের মধ্যে মানবিক আবেগের জটিলতায় নেভিগেট করতে সাহায্য করে।

পরিবারে সহমর্মিতা বাবা-মাকে তাদের সন্তানদের চাহিদা এবং অনুভূতি বুঝতে সাহায্য করে এবং সন্তানদের অন্যদের প্রতি সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা গড়ে তুলতে উৎসাহিত করে। বন্ধুত্ব এবং রোমান্টিক সম্পর্কের মধ্যে সহমর্মিতা বিশ্বাস এবং আপনত্ব বাড়িয়ে তোলে; আমাদের দুর্বলতাগুলি ভাগ করে নিতে এবং কঠিন সময়ে সমর্থন সহজ করে তোলে।

সহমর্মিতা একটি সার্বজনীন দক্ষতা যা যে কোনো সম্পর্ককে শক্তিশালী করতে পারে। এটি এমন একটি গুণ যা আমাদের অন্যদের সাথে গভীরতর স্তরে সংযোগ স্থাপন করতে, সমর্থন প্রদান করতে এবং অর্থপূর্ণ সংযোগ গড়ে তুলতে সহায়তা করে।

কার্যকর যোগাযোগ সহমর্মিতার ভুমিকা গভীর। সহমর্মিতা থাকলে কারও কথা সক্রিয়ভাবে শ্রবণ করা হয়, যার অর্থ সত্যিকার অর্থে শোনা এবং বোঝা। অন্য ব্যক্তি কী বলছে তাতে চিন্তাশীলভাবে সাড়া দেওয়া। অ-মৌখিক ইঙ্গিতও একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে – মাথা নেড়ানো, হাসি বা উদ্বিগ্ন চেহারা, মুখের কথার চেয়ে বেশি কথা বলতে পারে। সহমর্মী যোগাযোগের অর্থ হল বিচার-বিরত থাকা এবং বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি খোলামন থাকা।

যখন আমরা সহমর্মিতা নিয়ে যোগাযোগ করি তখন আমরা অন্যদের তাদের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি ভাগ করে নেওয়ার জন্য একটি নিরাপদ জায়গা তৈরি করি, বিচারের ভয় ছাড়াই। আমরা বিশ্বাস গড়ে তুলি, সংযোগ গভীর করি এবং শান্তিপূর্ণভাবে দ্বন্দ্ব নিরসনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলি।

তবে সহমর্মিতা সবসময় সহজ নয়। এতে মনের শক্তির প্রয়োজন হয়। এমন ভুল ধারণাও অনেকের মাঝে রয়েছে যে সহমর্মিতার অর্থ হল অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ হওয়া। তা ঠিক নয় সব আবেগ সমান তীব্রতার সাথে ভাগ করে নেওয়ার দরকার নেই। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে সহমর্মিতা স্বতঃস্ফূর্ত। তাও ঠিক নয়। সহমর্মিতা একটি দক্ষতা যা অনুশীলনের মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্র রয়েছে যেখানে সহমর্মিতা বিকাশ করতে পারে, যেমন:

  • অন্যদের কথা সক্রিয়ভাবে শ্রবণ করা;
  • তাদের শরীরী ভাষা এবং অ-মৌখিক ইঙ্গিতগুলির প্রতি নজর দেওয়া;
  • তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়গুলি দেখার চেষ্টা করা;
  • তাদের অনুভূতিগুলি অনুভব করার চেষ্টা করা;
  • সহায়তা এবং সমর্থন প্রদান করা।

একটি বৈচিত্র্যময় সমাজে সহমর্মিতা মানব অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যময় বর্ণালী জুড়ে একটি সেতুবন্ধ তৈরি করতে পারে। সহমর্মিতা আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে তাকাতে এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, জাতিগত এবং লিঙ্গের পটভূমির লোকদের বুঝতে উৎসাহিত করে। পক্ষপাত এবং বৈষম্য হ্রাস করার ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমন একটি সমাজ গড়ে তোলে যেখানে প্রত্যেকে নিজেকে মূল্যবান অনুভব করে।

সহমর্মিতা আমাদেরকে পক্ষপাত এবং বৈষম্য দূর করতে সাহায্য করতে পারে। যখন আমরা অন্যদের বুঝতে পারি, তখন আমরা তাদের প্রতি পক্ষপাতমূলক হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তাদের সাথে আরও ভালভাবে আচরণ করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সহমর্মিতা আমাদেরকে একটি আরও ন্যায্য এবং সমতার সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।

নেতৃত্বে সহমর্মিতা একটি বড় গুন। এটি নেতাদের তাদের দলের অনুভূতি এবং অনুপ্রেরণা বুঝতে সাহায্য করে, যার ফলে আরও সুসঙ্গত এবং উৎপাদনশীল কর্মক্ষেত্র তৈরি হয়। সহমর্মী নেতাদের আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে দেখা হয়। এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয় যেখানে কর্মচারীরা নিজেদের মূল্যবান অনুভব করেন।

সহমর্মী নেতাদের বৈশিষ্ট্য তারা তারা সক্রিয়ভাবে শুনতে পারেন। তারা তাদের দলের কর্মীদের কথা মনোযোগ সহকারে শোনেন এবং তাদের কী বলার আছে তা বোঝার চেষ্টা করেন। সহমর্মী নেতারা সহজেই তাদের দলের প্রয়োজনীয় সময় কর্মীদের কাছে আসতে পারেন।

সহমর্মী নেতৃত্বের সুবিধা হলো এটি আরও উৎপাদনশীল কর্মক্ষেত্র তৈরি করে। সহমর্মী নেতৃত্বে কর্মচারীরা আরও বেশি নিবেদিত এবং অনুপ্রাণিত হয়। যার ফলে আরও বেশি উৎপাদনশীল হয়।

প্রযুক্তি কখনও কখনও সহমর্মিতার জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে। অনলাইন ইন্টারএকশনে মুখোমুখি কথোপকথনের সূক্ষ্মতা এবং আবেগগত গভীরতা অনুপস্থিত থাকতে পারে। মুখোমুখি কথোপকথনে আমরা শরীরী ভাষা এবং অ-মৌখিক ইঙ্গিতগুলি অনুভব করতে পারি যা আমাদের অন্যদের অনুভূতি আরও ভালভাবে বুঝতে সাহায্য করে। অনলাইন যোগাযোগে এই ইঙ্গিতগুলি অনুপস্থিত থাকতে পারে, যার ফলে ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি বাড়ে। প্রযুক্তি আমাদের নিজেদের চারপাশের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে। আমরা যখন আমাদের স্মার্টফোন এবং কম্পিউটারে নিমগ্ন থাকি, তখন আমরা আমাদের চারপাশের লোকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করার এবং তাদের অনুভূতি অনুভব করার সময় কমিয়ে আনি।

যদিও প্রযুক্তি সহমর্মিতার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ উপস্থাপন করে, তবে এটি সহমর্মিতা বাড়িয়ে তোলার ক্ষেত্রেও নতুন সুযোগ তৈরি করে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটির মতো প্রযুক্তি আমাদের অন্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বকে অনুভব করার সুযোগ করে দেয় যা আমাদের তাদের অনুভূতি আরও ভালভাবে বুঝতে এবং গভীরতর সহমর্মিতার দুয়ার খুলে দিতে পারে।

শিক্ষায় সহমর্মিতা অন্তর্ভুক্ত করা কেবল একাডেমিক দক্ষতার জন্য নয়, তার চেয়েও বেশি। এটি আবেগগত এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করে। স্কুলে সহমর্মিতা শেখানো পারস্পরিক সম্মান এবং বোঝাপড়ার পরিবেশ তৈরি করে, শিক্ষার্থীদের শুধু শিক্ষাগত সাফল্যের জন্যই নয়, বরং সহমর্মী প্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে জীবনের জন্য প্রস্তুত করে। তারা আরও ভালভাবে দ্বন্দ্ব নিরসন করতে, আরও দয়ালু এবং বিবেচনাশীল হতে পারে।

সহমর্মিতা বিকাশের মাধ্যমে আমরা সবাই আরও বেশি সহানুভূতিশীল বিশ্ব তৈরিতে অবদান রাখতে পারি। সহমর্মিতা আমাদের অন্যদের সাথে আরও ভালভাবে সংযোগ স্থাপন করতে এবং তাদের সাথে আরও শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে। এটি দ্বন্দ্ব নিরসনে এবং আরও ভালভাবে কাজ করতে সাহায্য করতে পারে। সহমর্মিতা আমাদের সম্প্রদায়গুলিতে আরও বেশি সহনশীলতা তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। এটি আমাদেরকে একে অপরের প্রতি আরও দয়ালু এবং বিবেচনাশীল হতে সাহায্য করতে পারে। সহমর্মিতা আমাদেরকে আরও ন্যায্য এবং সমতার সমাজ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।

আসুন পুরোনো এই মুল্যবোধকে আবার জাগিয়ে তুলি। সুন্দর মায়াময় পরিবার, সমাজ ও পৃথিবী গড়ে তুলি।


Discover more from LK INNOVATE

Subscribe to get the latest posts sent to your email.

Leave a comment

Trending

Discover more from LK INNOVATE

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading